প্রশ্ন : আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী বিশ্লেষণ কর। অথবা, Analyze the powers and functions of the legislature অথবা, আইনসভা কাকে বলে? আইনসভার কার্যাবলি আলােচনা কর।
ভূমিকা
জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারের কার্যক্রম নির্ধারণ ও প্রয়োেগের ক্ষেত্রে আইন বিভাগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাছাড়া প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগকে অন্যান্য বিভাগ থেকে অধিক শক্তিশালী মনে করা হয়। বিভিন্ন দেশের আইনসভা বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করে থাকে সরকারের সংগঠন ও প্রকৃতির বিভিন্নতার কারণে আইনসভার
কাজের ভিন্নতা দেখা যায়। আইনসভাকে “জাতীয় মঞ্চ” বা জাতির দর্পণ বলেও অবিহিত করা হয়।
আইনসভা কি
সরকারের যে বিভাগ আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনবোধে প্রচলিত আইনের রদবন্দল এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কিছু বিচার বিভাগীয় কাজ করে তাকে আইন বিভাগ বলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner) এর মতে, “Of all the organs of the government, the legislature undoubledly occupies the paramount place.” অর্থাৎ, সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইনসভা হলাে একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে জনগণের প্রাধান্য থাকে।
অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) বলেছেন, “নির্বাহী ও বিচার বিভাগ উভয়েরই ক্ষমতাবলি সাধারণ আইনসভার ঘােষিত ইচ্ছানুসারেই নির্ধারিত হয়।
Oxford pictionary-র সংজ্ঞা অনুযায়ী “Legislature is a group of people. Who have the power to make and change laws.”
অর্থাৎ, আইনসভা হচ্ছে একদল লােকের সমষ্টি যাদের আইন তৈরি এবং পরিবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে।
সুতরাং আইনসভা হলাে একদল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত। যাদের মূল কাজ হলাে আইন প্রণয়নসংক্রান্ত নানাবিধ কাজ সম্পাদন করা।
আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী
১. আইন প্রণয়ন :
আইন সভার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আইন প্রণয়ন করা। আইন প্রণয়নের আগে খসড়া আইন প্রস্তুত করে এই খসড়া আইনের ওপর আলাপ-আলােচনা হয়ে থাকে গণপরিষদে। আইনসভা প্রণীত আইন দ্বারা শাসন কর্তৃপক্ষ শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং বিচার বিভাগ বিচারকার্য করে থাকে। সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকে আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে।
২. নিয়োগসংক্রান্ত কার্যাবলি :
আইনসভা অনেক সময় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ দান করে, সম্ধি বা চুক্তি অনুমোদন করে, যুদ্ধ ঘােষণা করে এবং আরও কিছু শাসন বিভাগীয় কার্যসম্পাদন করে থাকে। আইনসভা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শাসন বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্র বিন্তার করতে পারে। পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ সম্পূর্ণ দায়ী থাকে। প্রত্যেক দেশের আইনসভাই কিছু কিছু শাসন বিভাগীয় কাজ সম্পাদন করে থাকে।
৩. আইন সংশােধন :
আইনসভা দেশের মৌলিক আইন অর্থাৎ সংবিধান প্রণয়ন ও সংশােধন করে। কোনাে দেশের আইনসভা সংবিধান রচনার গুরুদায়িত্ব পালন করে। আবার এটি সংবিধান সংশােধনের কাজও করে থাকে। বাংলাদেশের আইনসভা ১৯৭২ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আইন তৈরি করতে কংগ্রেস সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারে। সংবিধান রচনা ও সংশাধন করা আইনসভার অন্যতম কাজ।
৪. বাস্তবসম্মত আইন প্রণয়ন :
আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী হলো আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু তা এত সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য অনেক আলাপ-আলােচনার প্রয়োজন। আইনের উদ্দেশ্যে ও নীতি সম্পর্কে আলােচনার সুযােগ আইনসভার সদস্যরা পান। এভাবে আলােচনা ও বির্তকের ফলে সুস্থ ও উন্নতমানের আইন ও শাসনসংক্রান্ত নীতি প্রণীত হয়।
জন স্টুয়ার্ট মিল (J. S. MiI)-এর মতে, আলােচনামূলক কার্যাবলির আলােকে আইন পরিষদকে দেশের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ও নেতৃত্বের আসর বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
৫. বিচারসংক্রান্ত কাজ :
কোনো কোনাে রাস্ট্রে আইনসভা বিচারসংক্রান্ত কিছু কাজ করে। আইনসভা নির্বাচনসংক্রান্ত বিবাদের নিষ্পত্তি করে। আইনসভায় বিচারে অভিযােগ প্রামাণিত হলে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হয়। ব্রিটেনের লর্ডসভা আপিলসংক্রান্ত বিচারের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে কাজ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিচারের ক্ষমতা আইনসভার ওপর ন্যস্ত। আইনসভা বিচারমূলক কাজ করে। কিছু কিছু অঙ্গরাজ্য বিচারকগণ জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত হন।
৬. জনগণের প্রতিনিধি :
আইনসভার সদস্যগন জনগণের প্রতিনিধি এবং দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা নির্বাচিত হন। সদস্যগণ তাদের নিজ নিজ এলাকার অভাব অভিযোগ সম্পর্কে আইনসভায় আলােচনা করেন এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। আইনসভার অন্যতম কাজ হলাে জনগণের অভাব অভিযাগ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা সরকারের কাছে তুলে ধরে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা।
অধ্যাপক হিচনার ও হারপােল্ড এর ভাষায়, “The legislature is that organ of the goverment intended most immnediately to be the voice of the people.” অর্থাৎ, আইনসভা সরকারের সেই বিভাগ যা জনগণের কণ্ঠম্বর হিসেবে ঐরিকান্তিক কাজ করবে বলে প্রত্যাশা করা হয়।
আরও পড়ুন >> ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবও নয় বাঞ্ছনীয় নয় । – ব্যাখ্যা কর।
৭. শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ :
কোনাে কোনাে দেশের আইনসভা শাসন বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। আইনসভা বিভিন্ন উপায়ে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে। আইনসভা প্রশ্ন জিজ্ঞাগা, অনাস্থা, প্রস্তাব, নিন্দাসূচক প্রস্তাবের মাধ্যমে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৮. রাজনৈতিক অংশগ্রহণে সহায়তা :
আইনসভায় নির্বাচন জনগণকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের কাজে উদ্বম্ধকরণের একটি অন্যতম হাতিয়ার আর এই রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার যথাযথভাবে ভােগ করার সুযাগ পায়।
৯. সরকার গঠন :
সাধারণত আইনসভাই প্রত্যেক দেশে সরকার গঠন করে। বিশেষ করে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত দেশগুলোকে আইনসভার নিমুকক্ষই কার্যত মন্ত্রিসভা গঠন করে থাকে। আর মন্ত্রিসভাই হলো প্রকৃত সরকার। ফ্রান্সে আইনসভার উভয় কক্ষ যৌথভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারে আইনসভা কার্যত মন্ত্রিসভা গঠন করে।
১০. নির্বাচনসংক্রান্ত :
আইনসভাকে নির্বাচনমূলক কাজও করতে হয়। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে পার্লামেন্ট এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপরাষ্ট্রপতি নর্বাচনের ক্ষেত্র সিনেটেরও অনুরূপ ক্ষমতা রয়েছে।
১১. রাজনৈতিক নিয়ােগ :
আইনসভা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশিক্ষক নিয়ােগে সাহায্যে করে। আইনসভার সদস্য হিসেবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে কোনাে ব্যাক্তি যে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নৈপুণ্য অর্জন করেন সটাই তাকে ভবিষ্যৎ কোনাে উচ্চ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পদ লাভে সাহায্যে করে।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী ভূমিকা অপরিসীম। সরকারের অন্যান্য বিভাগ থেকে এ. বিভাগের গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা দেশের মেরুদণ্ড হলাে আইন। বর্তমানে আইনসভার ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পেলেও আইনসভার গুরুত্বকে কোনােমতেই অস্বীকার করা যায় না। আইনসভার প্রতিনিধিগণ সরাসরি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ায়, তারা জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে।