প্রশ্ন : চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ভূমিকা বা কার্যাবলি আলােচনা কর। অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ভূমিকা কার্যাবলি বর্ণনা কর।
ভূমিকা
আধুনিক কালে উদারপন্থি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীসমূহের অস্তিত্ব অপরিহার্য বলে পরিগণিত হয়। চাপসৃষ্টেকারী বা স্বার্থকামী গােষ্ঠী সরকারী নীতিমালা প্রণয়ন, পরিবর্তন এবং সরকারি সিদ্ধান্তসমূহকে নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করত সচেষ্ট থাকে। অ্যালান বল তাই লিখেছেন যে,
The interest group is strong and
effective when it has a directed specific purpose.
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ভূমিকা বা কার্যাবলি
চাপসৃষ্টিকারীবা স্বার্থগোষ্ঠী গােষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কতকগুলোকা র্যসম্পাদনের মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে থাকে। নিম্নে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ভূমিকা ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলােচনা করা হলো :
১. সাধারণ নির্বাচনে সহায়তা প্রদান :
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী দেশের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের সমর্থিত দল বা ব্যক্তিকে জয়যুক্ত করার জন্য সাধ্যানুসারে প্রচেস্টা চালায়। এ জন্য তারা সমর্থিত দল বা ব্যক্তিকে অর্থ দিয়ে, যানবাহন দিয়ে প্রচার কাজে সাহায্য ইত্যাদির মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করে। তবে এর সাধারণ খারাপ প্রকৃতির। তাই জয়লাভের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এমন দল বা প্রার্থীকে সাহায্য সহযােগিতা প্রদান করে। তারা নির্বাচিত হলে এসব সাহায্যকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে।
২. আধুনিকীকরণের ওপর প্রভাব বিস্তার :
দেশগুলােতে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত শত্তিশালী চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী। সামরিক বাহিনী উন্নয়নশীল দেশসমূহে যথেষ্ট প্রভাব খাটাতে সক্ষম হয়। লে তারা সুকৌশলে নিজেদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে এবং দেশকে আধুনিকীকরণের দিকে ধাবিত করে।
৩. উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি :
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ভূমিকা কার্যকারিতার জন্য বিশেষ সহায়ক। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী নিজেদেরকে সুসংগঠিত করতে পারে। তাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
৪. বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবেশ গঠন :
বর্তমানে কোনাে রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর পক্ষে প্রত্যক্ষ প্রচার কার্য চালিয়ে সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী জাতীয় দাবি, স্বার্থ ও মূল্যবােধের সাথে একটি কার্যকরী সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।
৫. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাের ওপর প্রভাব :
চাপসৃষ্টিকরী গােষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে সচেস্ট হয়। ইউরােপ ও আমেরিকার শাসনব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীগুলাে আইন ও শাসন বিভাগকে প্রভাবিত করে নিজ নিজ গােষ্ঠী স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হয়।
৬. রাজনৈতিক কৃষ্টির ওপর প্রভাব :
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক কৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। রাজনৈতিক কৃষ্টি চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর অনুকূলে হলে তাদের পক্ষে দাবিদাওয়া আদায় সহজ হয়।
৭. তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে ভূমিকা :
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী সংবাদ এবং তথ্য সংগ্রহের অন্যতম উৎস। সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আইন সভার সদস্য, আমলা, সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসনের উচ্চতর পর্যায়েও তথ্য সরবরাহ করে। তাছাড়া এরা জনসাধারণের কাছেও বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সমর্থন সংগ্রহের চেষ্টা করে। যে কারণে পুস্তিকা প্রকাশ, জনসভা, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী তাদের বক্তব্য পেশ করে ।
আরও পড়ুন >> আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা মূল্যায়ন কর
৮. জনসংযোগ সাধনের ক্ষেত্রে :
উদারপন্থি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃস্টিকারী গোষ্ঠী সংযােগ সাধনে সাহায্য করে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য সংযােগ সাধনের উদ্যোগ ত্যাগ করতে পারে না। গণসংযোগের মাধ্যমে এরা জনগণের কাছে নিজেদের দাবির যৌক্তিকতা ও সরকারের জনম্বার্থবিরোধী নীতির সমালোচন করে। আবার অনেক সময় সরকারের পক্ষেও প্রচার কার্য চালায়।
৯. সরকারের ওপর প্রত্যক্ষ চাপসৃষ্টি :
আইনসভার সদস্য কিংবা মন্ত্রীদের দিয়ে সহজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনবোেধে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীসমূহ সরকারের ওপর প্রত্যক্ষ চাপৃষ্টির জন্য হরতাল, ধর্মঘট, ঘেরাও প্রভৃতি কৌশল অবলম্বন করে থাকে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে এভাবে পেশাজীবী সংগঠনগুলো এবং
ভিন্নধর্মী চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী তাদের দাবিদাবা আদায়ের জন্য ধর্মঘট করে থাকে।
১০. বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে :
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব থেকে বিচার বিভাগও সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের ওপর চাপসৃষ্টকারী গােষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের মাত্রা নির্ভরশীল। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের আইন ও সংবিধান ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা এবং আইন ও শাসন বিভাগীয় আদেশ ও চুক্তিকে সংবিধানবিরাোধী বলে ঘোষণা করার ক্ষমতা রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ । এক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্ঠী বিচারবাদের নিয়ােগ ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার জন্য সচেষ্ট হয়।
১১. রাজনৈতিক প্রচারের ক্ষেত্রে :
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী রাজনৈতিক প্রচার ও পরিচালনার একটি সংগঠিত মাধ্যম। এরা সবসময় ও সব দেশেই রাজনৈতিক দল দ্বারা পৃষ্ঠপােষিত। নির্বাচনি রাজনীতিতে বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। এমনকি চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর সদস্যগণ রাজনৈতিক দলের জন্য অর্থও সংগ্রহ করে থাকে।
১২. রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণ ও পরিবর্তন :
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীসমূহ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংরক্ষণে অথবা পরিবর্তন করার ক্ষত্রে অংশগ্রহণ করে। চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীসমূহ রাজনৈতিক বিচার বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়। সমাজতান্ত্রিক বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্ক আন্দোলন এবং ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে দেশের অনেক শ্রমিক, কৃষক, যুবক, কর্মচারী ও সংস্থা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আবার বিদ্যমান ব্যবস্থার সংরক্ষণেও তাদের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
১৩. সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা পালন :
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী সরকারের উপদেশ্টার ভূমিকাও গ্রহণ করে। কেননা বর্তমানে সরকার বিশেষ স্বার্থসংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন এবং ব্যবস্থা গ্রহণের আগে সংশ্লিস্ট গােষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সাথে আলােচনা করে। যার ফলশ্রতিতে সরকারগােষ্ঠীর অভিজ্ঞতা ও পেশাদারি বক্তব্যের মাধ্যমে আইন অথবা সিদ্ধান্তকে ত্রটিমুক্ত করার সুযােগ পায়।
১৪. সরকারের ত্রুটিবিচ্যুতি দূরীকরণ :
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রশাসনের দক্ষতা বজায় রাখা এবং ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করতে সাহায্য করে। এ গোষ্ঠী সরকারের ত্রটিবিচ্যুতি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালায়। এর ফলে সরকার নিজের ত্রুটি ও সীমাবন্ধতা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকে।
১৫. আইন ও শাসন বিভাগের সমন্বয়সাধন :
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো সরকার গঠনে সচেস্ট না হয়ে পরােক্ষভাবে সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। তাছাড়া এ প্রচেষ্টা আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ উভয়ের মধ্য কেন্দ্রীভূত থাকতে পারে। আইন ও শাসন বিভাগের প্রতিপত্তি সমপর্যায়ভুক্ত হলেও চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর প্রভাব শাসন বিভাগের ওপর অধিক মাত্রায় প্রতিফলিত হয়।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলােচনার পরিপ্রক্ষিতে বলা যায় যে, সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের ওপর চাপসৃষ্টকারী বা স্বার্থকামী গাষ্ঠীসমূহ বর্তমানে যথেস্ট প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। কাজেই কি উন্নত, কি অনুন্নত সব দেশেই প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। অধ্যাপক ফাইনার তাই বলেছেন,
“চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর স্বীকৃতি বাধ্যতামূলক হওয়া বাঞনীয়।”