প্রশ্ন : ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসসমূহ আলোচনা কর। অথবা ব্রিটিশ সংবিধান গড়ে উঠেছে, তৈরি হয়নি।- ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকা
গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান একদিনে তৈরি হয়নি। প্রায় পনেরােশ বছরের ক্রমবিকাশের ধারায় উৎপন্ন হয়েছে ব্রিটিশ সংবিধান। এই ব্রিটিশ সংবিধান কোনোে নির্দিষ্ট উৎস থেকে উদ্ভূত হয়নি। এ কারণেই ব্রিটেনের সংবিধানের কোনাে লিখিত রূপ নেই। রীতি ও ঐতিহ্য সংবিধানের ব্যাপক অংশকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা এত অনির্দিষ্ট যে, লিখথিতভাবে তাদের আকার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রীতি ও ঐতিহ্য ছাড়াও বিভিন্ন রকম সনদ, প্রথাগত আইন, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত প্রভৃতি ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস :
ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসসমূহ নিম্নে আলাচনা করা হলে :
১. সনদ :
ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসসমূহ এর মধ্যে সর্বপ্রথমেই উল্লেখ্য হলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক সনদপত্র, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল, পার্লামেন্টের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, শাসকের নিকট প্রেরিত তাৎপর্যপূর্ণ এক যুগান্তকারী বিভিন্ন আবেদন যেমন-১২১৫ সালের ‘অধিকার আবেদন‘ (The petiton of Rights of1628), ১৬৮৯ সালের ‘অধিকারের বিল’ (The Bill of Rights l689), ১৭০০ সালের মীমাংসার আইন (The Act of Setlement of 1700), ইত্যাদি সনদসমূহ উল্লেখযোগ্য।
২. পার্লামেন্ট প্রণীত আইন :
গ্রেট ব্রিটেনের কোনাে লিখিত সংবিধান নেই। কিন্তু তা সত্ব্বেও পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের মাধ্যমেই তার শাসনতান্ত্রিক বিধানের ব্যাপক অংশ গড়ে
উঠেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কার্যকাল, লর্ডসভা ও কমন্সসভার মধ্যে শাসনতান্ত্রিক সমপর্ক নির্ধারণ, নাগরিক অধিকার রক্ষা প্রভৃতির জন্য পার্লামেন্ট বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে। ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস এক্ট, ১৭০১ সালের সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন, ১৮৩২, ১৮৬৭ এবং ১৮৮৪ সালের সংস্কার আইন, ১৯১১ ও ১৯৪৯ সালের সংসদীয় আইন প্রভৃতি আইন ব্রিটিশ সংবিধানের গুরত্বপূর্ণ উৎস।
৩. প্রথাগত আইন :
ব্রিটিশ সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলাে প্রথাগত আইন। দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত প্রথা রাষ্ট্র কর্তৃত্ব এবং বিশেষডাবে আদালত কর্তৃক স্বীকৃত অর্জন করলেই আইনের মর্যাদা অর্জন করতে পারে। অগ এর মতে, প্রথাগত আইন হলাে আইন সম্পর্কিত নীতি সিন্ধান্তের মাধ্যমে তাদের নিরন্তর বিকাশ ঘটেছে। তাই ‘প্রথাগত আইন কে বিচারপতি দ্বারা ‘প্রণীত আইন’ নামে উল্লখ করা হয়।
৪. বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত :
বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম উৎসরূপে পরিগণিত হয়। আদালত প্রথাগত আইন এবং পার্লামেন্ট প্রণীত আইন ব্যাখ্যা করে কোনাে মামলার ক্ষেত্রে যখন আইনের ব্যাখ্যা করে, পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিচারপতিগণ প্রতিষ্ঠিত নীতির ভিত্তিতে মামলার নিস্পত্তি করেন। এই রায় রাষ্ট্রীয় আইনের অংশে পরিণত হয়। বিচারপতিগণ মামলার শুনানির সময়ে আইনের দোষত্রটি সম্পর্কে যে বক্তব্য রাখেন তার অনুসরণ পার্লামেন্ট যদি সংশ্লিষ্ট আইন সংশােধন করে তাবে বিচার বিভাগর সিদ্ধান্ত ঐ নির্দিষ্ট ক্ষেত্র আইনের উৎসে পরিণত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে রবিন আ্যান্ড সন লিমিটেড বনাম স্বাস্থ্যমন্তরী(১৯২৯), লিভারসিজ বনাম আ্যান্ডারসন (১৯৪২) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
৫. সাংবিধানিক রীতিনীতি :
বিভিন্ন দেশের সরকারের বিভিন্ন সংস্থার গঠন, কার্যাবলী এবং ক্ষমতা প্রয়োেগের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একটি বিষয় আত্যন্ত স্পস্ট হয়ে উঠেছে যে, লিখিত অথবা অলিখিত সংবিধান কেউই এককভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে সব নিয়ম ও পদ্ধতি উপস্থিত করতে পারে না। সংবিধানের লিখিত আইনকে রীতিনীতির মাধ্যমে শক্তিশালী করা প্রয়ােজন। রীতিনীতি আইনের ত্রুটি ও সীমাবন্ধতাকে দূর করে তাকে গতিশীল ও প্রাণবন্ত করে তােলে। রীতিনীতিকে সংক্ষেপে সংবিধানের অলিখিত নিয়মাবলি বলা যায়।
আরও পড়ুন >> জনমত কি? জনমত গঠনের উপাদানসমূহ আলােচনা কর
৬. শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত গ্রন্থ :
সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনবিদ ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত প্রামাণ্য পুস্তকসমূহ ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। উদাহারণস্বরূপ সরকার ওয়াল্টার বেজহট এর ইংল্যান্ডের শাসনতন্ত্র অ্যানসন এর শাসনতন্ত্রের আইন ও নীতি ‘আইন এবং শাসনতন্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থে আইনের অনুশাসনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
৭. প্রখ্যাত লেখকদের রাচনা :
প্রখ্যাত আইনবিদ, লেখকদের রচনাবলিও ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম উৎস। তাদের রচনায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে যে অভিমত ব্যস্ত করা হয়েছে সেই অভিমতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কোনাে সংস্থা পদাধিকারীদের সম্পর্কিত বিরােধ ও
বিভ্রান্তি দূর করার চেন্টা করেন। গ্রট ব্রিটেনের পার্লামেন্টের কার্যাবলি পরিচালনার ভিত্তি হলাে মে (May) এর বক্তব্য ও বিশ্লেষণ। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যকে ইংরেজ জাতির সাংবিধানিক কাঠামাে পরিচালনার উৎসরূপে গণ্য করা হয়।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্রিটিশ সংবিধানের গুরুত্ব বা অবদান অপরিসীম। তবে এ সংবিধান একটি নির্দিন্ট উৎস থেকে গড়ে উঠেনি। ঐতিহাসিক অন্যান্য প্রথ্যাত আইন বিশারদ ও সংবিধান প্রথাগত আইন, সাংবিধানিক রীতিনীতি প্রভৃতিই ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসসমূহ । মুনরো এবং এয়া্ট যথার্থই মন্তব্যে করেছেন,
ব্রিটিশ সংবিধান হলাে প্রতিষ্ঠান, নীতি এবং নীতির এক জটিল সম্বয়। এই সংবিধান পূর্ণাঙ্গ দলিল নয়, নিরন্তর বিকাশ হচ্ছে।