প্রশ্ন : ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবও নয় বাঞ্ছনীয় নয় । – ব্যাখ্যা কর। অথবা, ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবও নয়, কাম্যও নয়। -উক্তিটির যথার্থ বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকা
রাজনীতির মূল লক্ষ্য রা কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ক্ষমতা অর্জন। মনুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হবার পরই ক্ষমতা রাজনীতির এক ব্যাপক আলোচ্য বিষয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা একদিকে সরকারকে স্বেচ্ছাচারী করে তােলে । অন্যদিকে, নাগরিক স্বাধীনতাও খর্ব করে। তাই সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা ও নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সর্বপ্রথম ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবর্তন করেন। আধুনিক কালে মন্টেস্কু এ নীতির প্রবর্তন করেন এবং ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবও নয় বাঞ্ছনীয় নয়
ব্যাখ্যা :
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি আলােড়ন সৃষ্টি করলেও এ তত্ত্র ভীষণভাবে সমালােচনার সম্মুখীন হয়। অনেকেই এ তত্ত্বের সমালোচনা করে বলেন যে, ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবও নয়, বাঞ্ছনীয় নয়।” নিম্বে এ উক্তির পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি পেশ করা হলো–
১. সরকারের বিভাগগুলাে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল :
আধুনিক সরকার ব্যবস্থায় কোনো এক বিভাগকে অন্য বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। কারন সরকারের বিভাগগুলো পরস্পরের সাথে এমনভাবে জড়িত য, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের সুষ্ঠ নীতি আনুযায়ী সংবিধানকে কার্যকর রাখা সম্ভব নয়। যদি পৃথকীকরণ সম্ভব হতা তাহলে পৃথিবীর কোনাে না কোনাে রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ পৃথকীকরণ অবশ্যই দেখা যেত।
২. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণে রাষ্ট্র নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে :
আধুনিক সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতার পূর্ণ স্বত্রীকরণ বা পৃথকীকরণ মাটেই সম্ভব নয়, এ সম্পর্কে ব্রুন্টসলি একটি চমৎ্কার উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, জীবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন পরস্পরের সাথে রত্তমাংসের সম্পর্কে আবদ্ধ তেমনি সরকার এর তিনটি বিভাগও পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ।” এর একটিকে অপরটি হতে পুরোপূুরি বিচ্ছিন্ন করলে সরকারের অপমৃত্যু ঘটে। ফলে রাষ্ট্র নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে।
৩. রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ফলে সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে না। জন, স্টুয়ার্ট মিল বলেন, “সরকারের প্রতিটি বিভাগ যদি নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র হয় তাহলে একে অপরের কাজ হস্তক্ষপ করবে এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে।” অধ্যাপক লাস্কি এর মতে, “সরকারের তিনটি বিভাগকে পৃথক করা হলে প্রতিটি বিভাগই নিজ নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যের ওপর চাপানাের চেষ্টা করবে। ফলে শাসনব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃস্টি হবে।”
৪. সরকার অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য :
আধুনিক কালে সরকারের কোন বিভাগই কেবল নিজস্ব বিভাগীয় কার্য সম্পন্ন করে না বরং তাদের অন্যান্য বিভাগীয় কাজেও হস্তক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়। তাই বলা. যায়, সরকার এক, অথন্ড ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা। কোনােভাবেই একে পৃথক সমীচীন নয়।
৫. জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অনুপযােগী :
কয়েকজন জনকল্যাণকর নীতির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকর করা সম্ভব নয়।” কারণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির জটিলতা কল্যাণকর রাষ্ট্রের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।
৬. ফাইনারের অভিমত :
অধ্যাপক ফাইনার বলেন, “পরিপূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগ করলে সরকার কখনাে মূর্ছিত হবে, কখনো হাত পা ছুড়তে থাকবে।” যারা শাসনকার্যে নিযুক্ত আছেন তারাই উপলব্ধি করতে পারেন কিরৃপ আইন প্রয়ােগ করলে তাদের দায়িত্ব পালনে সুবিধা হবে। আইন প্রণয়নে যদি তাদের নিজস্ব ক্ষমতা না থাকে তাহলে শাসনকার্য পরিচালনা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৭. ভ্রান্ত নীতি :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ধারণা ভ্রান্ত। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ব্যতীত ব্যক্তিম্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হত অভিমত যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা একমাত্র উপাদান নয়।বরং জাগ্রত জনমত এবং জনগণের সতর্ক দৃষ্টিই ব্যক্তিম্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ।
আরও পড়ুন >> ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সুবিধাসমূহ আলোচনা কর
৮. ক্ষমতার পৃথকীকরণে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সৃষ্টি :
অধ্যাপক লাস্কি বলেন, “আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ যদি সম্পূর্ণ পৃথকভাবে কাজ করে তাহলে প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বশীলতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত, হবে। ফলে স্বতন্ত্র বিভাগগুলাে পরস্পরের মধ্যে সংঘাত আনবে এবং সংঘােত থেকে বিপ্লব সৃষ্টি হবে।”
৯. কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় :
ক্ষমতা গৃথকীকরণ নীতির কঠোের প্রয়ােগ সরকারের বিভাগগুলাের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। ফলে এতে ঐক্যের মনােভাবে ক্ষুণ্ন হয় এবং সরকারের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। ম্যাকাইভার এর মতে, “এ নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়ােগের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য সৃষ্টি হবে।” তাই ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য অবাঞ্ছনীয় বটে।
১০. সরকার তিনটি বিভাগের মধ্যে সীমাবন্ধ নয় :
অনেক লেখক এ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সরকারের কাজ কেবল এ তিনটি বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আচার গুডনার্ড ও আন্যান্য লেখকের মতে, সরকারের কাজ দুই শ্রেণির। যথা : আইন প্রণয়ন করা এবং আইন অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করা।
১১. সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় গতিশীল নয় :
বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশেই সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগের ক্ষমতা মন্ত্রিসভার হাতে থাকে। তাই এক্ষেত্রে ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অভিপ্রেতও নয়।
১২. মন্টেস্কুর ধারণা সংকীর্ণ :
ক্ষমতার অপব্যবহার রােধ করার একটি প্রতিষ্ঠানগত উপায় উদ্ভাবন করতে গিয়ে মন্টেস্কু ব্রিটেনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক যথেস্ট প্রভাবিত হয়েছিল। অধ্যাপক ফাইনারের মতে, “মন্টেস্কু দুটি মূল বিষয়ের প্রস্তাব করেন যেগুলোর মধ্যে কোনাে অপরিহার্য যােগসূত্র নেই। প্রথমত, সরকারের বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতা রয়েছে এবং দ্বিতিয়ত, স্বাধীনতা লাভ করতে হলে ক্ষমতাকে কোনাে প্রকারেই কেন্দ্রীভূত করা যাবে না।”
১৩. অবাস্তব নীতি :
পৃথিবীর কোনাে রাষট্রেই ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেনি। মন্টেস্কু তার মত ব্যক্ত করার সময় বার বার ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। কিন্তু বৃটেনে সরকারের বিভাগগুলাে আলাদা হলেও ক্ষমতার একত্রীকরণ লক্ষণীয়। ব্রটিশ পার্লামেন্টের সদস্যগণই মন্ত্রিসভার সদস্য এবং লর্ডসভা বিচারসংকান্ত সর্বোচ্চ আপিল আদালত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা স্বত্ত্রীকরণ নীতির যথার্থ প্রয়োগ দেখা যায় বটে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে অবাস্তব প্রমাণ করেছে। রাষ্ট্রপতি, কংগ্রেস ও সুপ্রিম কোর্ট পরস্পর পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ মূলত অবাস্তব নীতি।
১৪. আইন বিভাগের প্রাধান্য :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে মানতে হলে প্রত্যেক বিভাগকে ক্ষমতাসম্পন্ন করা দরকার। কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্রে আইন বিভাগের স্থানই সকলের উর্ধ্বে। শাসন বিভাগের ওপর আইন বিভাগের অল্প বা অধিক নিয়ন্ত্রণ
আছে। ব্রিটেনে অধিক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অল্প।
উপসংহার
উপরের আলোেচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমান যুগে শাসন ক্ষেত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পুরোপুরি প্রয়ােগ সম্ভব নয়। কারণ নানাভাবে সরকারের ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যেক বিভাগকেই একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে কাজ করতে হয়। মূলত শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক রেখে কোনাে সরকারই গঠন করা, যায় না। ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবও নয় বাঞ্ছনীয় নয় কারন এ নীতির প্রয়োগ কোনাে আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সম্ভবও নয় এবং যুক্তিযুক্তও নয়। সুতরাং সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে পৃথক করার প্রয়ােজন নেই। বরং এদের সুবিন্যস্ত এবং দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করাই বাঞ্ছনীয়।