সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি আলােচনা কর

প্রশ্ন : সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি আলােচনা কর।
অথবা, সংবিধানের সংজ্ঞা দাও। সংবিধান প্রণয়নের বিভিন্ন পদ্ধতি উল্লেখ কর।

ভূমিকা :

সংবিধান একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি। সংবিধান ব্যতীত আধুনিক গনতান্ত্রিক রাস্ট্র কল্পনা করা যায় না। এই সংবিধান বিভ্ন্ন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজশক্তি অথবা স্বৈরাচারী শাসন থেকে পরিত্রাণের জন্য সংবিধান জনগণ কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়। সংবিধান সরকার ও জনগণের মাঝেঝ সম্পর্ক নির্ধারণ  করে দেয়।

সংবিধানের সংজ্ঞা :

সংবিধানে লিখিত আকারে রাষ্ট্রের মূলনীতি রীতিনীতি, আচারণ, গণপরিষদের নেতৃত্বের দ্বারা প্রযুক্ত আইন
সংযুক্ত থাকে। রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত প্রভূতির সমন্বয়ে সংবিধান গড়ে ওঠে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
এরিস্টটল বলেন, “Constitution is the way of life the
state has chosen for itself”” অর্থাৎ সংবিধান এমন একটি জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র নিজের জন্য বেছে নিয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেলিনেক (Jellineck) বলেন, “Costitution
is a body of judicial rules which determine the
supreme organs of the states, prescribe their mode
of creation, their mutual relation, their sphere of
action and finally the fundamental place of each of
them in relation to the state.” অর্থাৎ সংবিধান হচ্ছে
বিচার বিভাগীয় বিধি বিধানের এমন এক সমন্টি যেগুলো রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ বিভাগগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারণ করে, তাদের সৃষ্টির প্রক্রিয়া, পারসপরিক সম্পর্ক, কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের মূল ক্ষেত্র স্থির করে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লীকক (Leaeock) এর কথায়, “Constitution is nothing but the form of government.” অর্থাৎ সংবিধান সরকারি ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়।

লুইস (Lewis) সংবিধানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “Constitution signifies  distribution of the sovereign power in the community of govermment.” অর্থাৎ, সংবিধান কোনো সমাজে সার্বভৌম ক্ষমতার বিন্যাস ও বণ্টন সম্পর্কে সরকারের বৃপ নির্দেশ করে।

সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি সমূহ :

সংবিধান হঠাৎ একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে একটি দেশের সংবিধান গড়ে ওঠেছে। অধ্যাপক গেটেলের মতে, আধুনিক বিশ্বে চারটি উপায়ে সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যথা : ১. অনুমোদন বা রাজ আদেশ  ২. ইচ্ছাকৃত রচনা বা গণপরিষদ ৩. ক্রমবিবর্তন ৪. বিপ্লব। নিম্নে সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি আলোচনা করা হলাে :

অনুমােদন বা রাজাদেশ :

আধুনিকতার সাথে সাথে জনগণের মাঝে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। স্বৈরাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী ওঠে। আধুনিক জনগণের ওপর কিছু ধারণা। জনগণ নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার
নিপাড়নের দ্বারা জনগণের অধিকারকে দমন করত তত্কালীন গ্রেট ব্রিটেনের রাজা জন নাগরিক সমাজের সনদ ম্যাগনাকার্টায় প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন। এভাবে ১৭৯৯ সালে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন এবং ১৯০৫ সালে রুশ সম্রাট দ্বিতীয় জার নিকোলাস নিজ নিজ দেশের সংবিধান ঘোষণা করেন। প্রাচীনকালে রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে গণ্য করা হতা। রাজার ইচ্ছাই ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে জনগণের অধিকার হরণ করা হতাে। জনগণ রাজার ইচ্ছাকে পবিত্র জ্ঞান করে তা মেনে নিত। গনতান্ত্রিকভাবধারা বিকাশের সাথে সাথে জনগণের  স্বাধীনতার প্রতি প্রবল স্পৃহা জাগে। আর সেই থেকে রাজার  ক্ষমতা হ্রাসে জনগণ সচেন্ট হয়। আধুনিকতা তথা পুজিবাদের বিকাশ এবং সামন্তবাদের ক্রমক্ষয়িষু প্রেক্ষাপটে রাজা জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নেয়। আর এভাবেই কতিপয় সংবিধানের অভিব্যন্তি প্রকাশিত হয়। রাজা এ সংবিধান তার ইচ্ছামতাে পরিবর্তন করতে পারতেন আবার কানাে কোনা ক্ষেত্রে জনগণের মতামত ছাড়া রাজা তা পরিবর্তন করতে পারতেন না।

গণপরিষদ :

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্বাধীনতা সংগ্রামের অব্যবহিত পরেই সংবিধান অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রবর্তনের দাবিওঠে। এ সংবিধানে সে দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের অভিব্যক্তি  ফুটে ওঠে। গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের প্রবল বাসনা থেকে সুষ্ট
অভ্যথানের আঅভিব্যন্তিও এই সংবিধানে ফুটে ওঠে। এ সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে এ সংবিধানে। জনপ্রতিনিধিরা সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণ পরিষদের বিশেষ সম্মেলন আহ্বান করে থাকেন। সংবিধান রচনা কমিটি জনপ্রতিনিধিদের সম্মতিতে গঠিত হয়। এই সংবিধান প্রণয়ন কমিটি নির্দিন্ট কার্যদিবসের মধ্যে খসড়া সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বে থাকে। জনগণের দাবির প্রতি পূর্ণ মনােযােগ রেখেই এ সংবিধান রচনা করা হয় বলে এই পদ্ধতিতে  প্রণীত সংবিধান শ্রেষ্ঠ সংবিধান। খসড়া সংবিধান অনুমোদনের জন্য গণপরিষদের অধিবেশনে উথাপন করা হয়। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা এই খসড়া সংবিধান চূড়ান্তরভাবে গৃহীত হয়। এই সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য এবং সংবিধানের মূলনীতিগুলোর বৈধতা অর্জনের জন্য অনেক সময় গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়।
সম্মতিতে কার্যকরী হয়। এ সংবিধানের ধারা উপধারা, সংশোধনের রীতিনীতিও এই সংবিধানে উল্লেখ করা থাকে।

ক্রমবিবর্তন :

একটি দেশের প্রচলিত রীতিনীতি ক্ররমবিবর্তনের ধারায় সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে। ব্রিটেনের সংবিধান এর প্রকৃত উদাহরণ। ব্রিটেনের সংবিধান এক দিনে প্রণীত হয়নি,
এটি ক্রমবিবর্তনের ধারায় বিকশিত হয়েছে। নগর রাস্ট্র (City State)→সাম্রাজ্য (Empire) →জাতি রাষ্ট্র ( Nation state) সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
যেখান জনগণই হবে প্রধান ও শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু।  নগররাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্য এবং সাযমাজ্য থেকে জাতিরাষ্ট্রের বিকাশের সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রাজা থেকে জনগণের হাতে চলে আসে। জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রক্ষাপটে প্রচলিত অনেক রীতিনীতি, প্রথা বিবর্তনের ধারায় সংবিধানের অংশে পরিণত হয় এবং “Top down
approach” থেকে “Down up approach” বিকশিত হয়। যেখানে রাজার ইচ্ছা তথা রাজার অবস্থান নামে মাত্র হয়ে
ওঠে। রান্ট্রয় ভজীবনে জনগণের ইচ্ছাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে জনগণের অনুশীলনকৃত বিভিন্ন রীতিনীতি সার্বভৌম কর্তৃূ্পক্ষের দ্বারা সংবিধানের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়।

বিপ্লব :

ফরাসি বিপ্লবের পর কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বিকশিত হতে থাকে। “জনগণ সব ক্ষমতার উৎস” এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।
রুশো ভলতেয়ার তাদের লেখনি দ্বারা ‘Popular democracy ধারণা বিকশিত করেন। ১৯১৭ সালে বুশ বিপ্লবের পর জনকল্যাণ নিমিত্তে সংবিধান গৃহীত হয়। রাজা তথা সাম্রাজ্যবাদী শাসকের Absolute power হাসের জন্য জনগণ বিপ্লবে অংশ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় সংবিধান রচিত হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পরে একইভাবে সংবিধান রচিত হয়। এই সংবিধানে ইসলামি আইন ও জীবনধারার ওপর জার দেওয়া হয়। খসড়া সংবিধান জনগণের ভােটের দ্বারা চূড়ান্তভাবে গৃহীত ও
বিধিবন্ধ হয়। নির্যাতিত জনগণ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অত্যাচারী শাসককে উৎ্খাত করতে না পারলে বিপ্লবে অংশ নেয় । স্বৈরাচারী শাসকের নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হ্তান্তরের পথ রুন্ধ করে দেয়। ফলে বিপ্লবে সংঘটন ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না, এই স্বেচ্ছাচারী শাসকদের ক্ষমতা থেকে নামানাের জন্য। এই প্রক্রিয়ায় গৃহীত সংবিধানে  বিপ্লবের আদর্শ ও লক্ষ্য প্রতিফলিত হয়। বিপ্লবের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামাে পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তিত সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় কাঠামাের সাথে সংগতি রেখে এই সংবিধান গৃইীত হয়।

আরও পড়ুন >> বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতিসমূহ আলােচনা কর

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সংবিধান এক দিনে তৈরি হয় না। এর পিছনে একটা প্রেক্ষাপট থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংবিধান অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সংবিধান জনগণকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করে সংবিধানের গৃহীত ধারা উপধারা জনগণের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে গৃহীত হয়। শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক স্থাপিত হয় সাংবিধানিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে।

শেয়ার করুন :

1 thought on “সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি আলােচনা কর”

Leave a Comment