বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতিসমূহ আলােচনা কর

প্রশ্ন : বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতিসমূহ
আলােচনা কর। অথবা, কোন কোন পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সংবিধান তৈরি হয় বিবরণ দাও।

ভূমিকা :

সংবিধান একটি রাস্ট্র পরিচালনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মুল্যবান ও সর্বোচ্চ দলিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উৎতকৃষ্ট সংবিধান লাভ করে। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিকসহ যাবতীয় বিষয়াবলির দিকনির্দেশনা বর্ণিত রয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতিসমূহ :

নিম্নে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতিসমূহ আলােচনা করা হলাে :

অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি :

বাংলাদেশের জন্য একটি সুষ্ঠ, উত্তম ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতাত্তোর কালে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, অস্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন তার মধ্যে সর্বপ্রথম। ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্ট্রপতি হিসেবে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এ সংবিধান আদেশ জারির পটভূ্মিকায় বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল
আদেশ ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একট অস্থায়ী ব্যবস্থা এবং যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ স্বাধীনতা আদেশ জারি করা হয়েছিল মুজিবনগরের ঘােষিত স্বাধীনতা তার অবসান ঘটেছে। তাছাড়াও এদেশের গণমানুষ সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবরর্তনের ইচ্ছা পােষণ করেন। ফলে জনগণের আশা আকাঙ্কা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষিতে এ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এ অস্থায়ী সংবিধান আদেশে বাংলাদেশের জন্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুযােগ সৃষ্ট হয়। এ সংবিধান আদেশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে নামেমাত্র প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রকে প্রকৃত প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ আদেশ জারির পরদিনই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রসিভাও গঠিত হয়। শেখ মুজিবের প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ২৩ জন। 

গণপরিষদ আদেশ জারি :

বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান রাচনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ বাংলাদেশ গণপরিষদ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন। এ আদেশ অনুসারে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর হতে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত সাবেক পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের আসনসমূহের বাংলাদেশ হতে নির্বাচিত সব সদস্য সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। মৃত্যু এবং অন্য কোনো কারণে বা আইনে অযোেগ্য বলে ঘােষিত হওয়ার ফলে সর্বমোেট (১৬৯ + ৩১০) ৪৭৯ জন সদস্যের স্থলে ৪০৪ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ কার্য পরিচালনা শুরু করে। পরবর্তীকালে যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে আরও কিছু সদস্য গ্রহণ করা হয়। এরৃপে গণ পরিষদ সর্বমােট ৪৩০ জন সদস্য নিয়ে কাজ শুরু করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের হয়। গণপরিষদকে আইন প্রণয়ন সং্ক্রান্ত কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শকমে গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করতে, স্থগিত করতে এবং পরিষদ ভেঙে দিতে পারবেন। গণপরিষদ একজন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করতে পারবেন। ঐ একই তারিখে রাষ্ট্রপতি ‘গণপরিষদ সদস্যপদ বাতিল আদেশ নামে আর একটি আদেশ জারি করেন। উক্ত আদেশ অনুসারে কোানো সদস্য তার দল হতে পদত্যাগ করলে অথবা বহিস্কৃত হলে পরিষদে তার সদস্যপদ বাতিল হবে। এতদসংক্রান্ত একটি ধারা পরে নতুন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন :

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সংবিধান সম্পর্কে প্রস্তাব দেশের বিভিন্ন সংগঠন ও আগ্রহী ব্যক্তিগণের নিকট থেকে আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেন। কমিটি বিভিন্ন মহল থেকে ৯৮টি প্রস্তাব বা সুপারিশ লাভ করেন। ১৯৭২ সালের ১০ জুন উক্ত কমিটি এক বৈঠকে সংবিধানের একটি প্রাথমিক খসড়া অনুমোেদন করেন। বাংলাদেশের সংবিধান সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করবে বলে স্থির ছিল, সেহেতু এ সংবিধান কে আরও পূর্ণাঙ্গ ও যথাসম্ভব ফলপ্রসূ করে তােলার উদ্দেশ্যে কমিটির সভাপতি আইনমন্ত্রী কামাল হাসেন ভারত ও ইংল্যান্ড সফর করেন এবং সেখানকার পার্লামেন্টের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করেন। বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়াকে ত্রুটিমুক্ত ও নিখুত করার জন্য কমিটি একজন ব্রিটিশ খসড়া বিশেষজ্ঞের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করেন। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ছয় মাসের মধ্যে ভবিষ্যৎ সংবিধানের খসড়া রচনা সম্পন্ন করেন। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর কমিটি সর্বশেষ আলাপ আলোচনা করে এবং ঐ দিনই সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ খসড়া চুড়ান্তভাবে গ্রহণ করেন।  খসড়া কমিটি সর্বমােট ৭৪টি বৈঠকে ৩০০ ঘণ্টা ব্যয় করে তাদের খসড়া চৃড়ান্ত করেন।

গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন :

১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। সে দিনই আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক কমিটি কর্তক উখাপিত সংশােধনীর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে খসড়া সংবিধান কমিটির সভাপতি ড. কামাল হােসেন সংবিধানটিকে বিল আকারে গণপরিষদে পেশ করেন। ১৩ অক্টোবর গণপরিষদ কতিপয় সংশোধনী সমেত খসড়া সংবিধানের কার্যপ্রণালি সক্রান্ত বিধিমালা গ্রহণ করে। সংবিধান বিলটি উপস্থানকালে ড. কামাল হােসেন বলেন, “এ সংবিধান গণতান্ত্রি উপায়ে এক শােষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে এটি এমন এক সমাজব্যবস্থা যাতে আইনের শাসন, মৌল মানবিক অধিকার এবং স্বাধীনতা, সাম্য ও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক  ও সামাজিক ন্যায়বিচার সব নাগরিকের জন্য অর্জিত হবে”।

খসড়া সংবিধানের চুড়ান্ত অনুমোদন :

বিভিন্ন দল, গােষ্ঠী ও সংগঠন কর্তৃক উথাপিত মতামত, আলােচনা সমালােচনার প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর খসড়া সংবিধান বিলের ওপর সাধারণ আলােচনা আরস্ড হয়। ১৯ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর সাধারণ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। ৮ দিনে মােট ১০টি বৈঠকে প্রায় ৩২ ঘণ্টা ধরে আলােচনা চলে। গণপরিষদের মােট সদস্য সংখ্যা ছিল ৪০০ জন, কিন্তু খসড়া সংবিধান সংক্রান্ত সাধারণ বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন মােট ৪৮ জন। বিতর্কে অংশগ্রহণকোরী ৪৮ জন সদস্যের মধ্যে ১৬ জনই ছিলেন খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে ৭৭৫টি সংশোেধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এ সংশােধনী প্রস্তাবগুলো থেকে ৮০টি সংশােধনী প্রস্তাব চুড়ান্তরূপে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের একটি আনুষ্ঠানিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে পরিষদ সদস্যগণ হস্তলিখিত একটি সাংবিধানিক দলিলে স্বাক্ষের দান করেন। ন্যাপ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এতে স্বাক্ষের দানে বিরত থাকেন। বিজয়  অর্জনের বছরপৃর্তির দিনে ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকরী হয় এবং সেই দিন গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন >> রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রয়ােজনীয়তা আলােচনা কর

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সংবিধান গণতান্ত্রিকভাবে গৃহীত সংবিধান। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশি জাতির প্রতীক এই সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধান একটি মৌলিক এবং সার্বভৌম সংবিধান। এই সংবিধানকে উত্তম সংবিধান বলা হয়।

শেয়ার করুন :

Leave a Comment