প্রশ্ন : বাঙালি জাতির উৎপত্তি আলােচনা কর। অথবা, বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে বর্ণনা দাও।
ভূমিকা :
ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে জানা যায় বাঙালি জাতির উৎপত্তি শুরু হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব চতূর্থ শতাব্দীতে । বাংলা ঐশ্বর্যসমূদ্ধ এলাকা হওয়াতে প্রাচীন কাল থেকেই এদেশে বহু মানুষের আগমন ঘটেছে। তবে বর্তমান বাঙালি জাতি যেসব নরগােষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো অস্ট্রেলীয়, দ্রাবিড়, মােঙ্গলীয়, ককেশীয় প্রভূতি। গবেষকরা বাঙালি জাতির বিভিন্ন দিক যেমন তাদের রক্ত, ভাষার প্রকৃতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়গুলযে নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং তার সিদ্ধানে পৌছেছেন যে, বাঙালি জাতি হলাে একটি সংকর জাতি।
[ez-toc]
বাঙালি জাতির উৎপত্তি :
জাতির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Nation’. বাঙালি জাতিরও রয়েছে উৎপত্তির সুম্পষ্ট ইতিহস। নিম্নে বাঙালি জাতির উৎপত্তি ইতিহাস আলাচনা করা হলো।
ভাষা :
বাঙালি বলতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে বুঝায়। এ বাংলা ভাষা ভিত্তি স্থাপন করেছিল বাংলাদেশের আদিবাসীরা। আর এদেশের আদিম আধিবাসীরা ছিল প্রাক-দ্রারবিড় গোষ্ঠীর। এ প্রাক-দ্রাবিড় গােষ্ঠীর ভাষা ছিল অস্ট্রিক। অস্রক ভাষার শব্দ ভারতীয় উপমহাদেশের সব ভাষাতে থাকলেও বাংলা ভাষায় এ শব্দের প্রভাব বেশি। আর এ ভাষার ওপর ভিত্তি করেই বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে।
অবিশুদ্ধ নরগােষ্ঠী :
বাঙালি জাতির জন্ম হয়েছে বিভিন্ন জাতি মানুষের সমন্বয়ে। বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী রিজলে তাঁর “Tribes andCastes of Bengal’ গ্রন্থে বিভিন্ন আলোচনা পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষ কোনো একক নরগােষ্ঠী দ্বারা তৈরি হয়নি, বরং বাঙালি জাতি হলো একটি অবিশুদ্ধ জাতি গােষ্ঠী। তাঁর মতে, বাঙালি জাতির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ মােঙ্গালীয় মুখের দাড়ি গোফের প্রাচুর্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌছান বাংলার মানুষের মধ্যে দ্রাবিড় ও মোঙ্গোলিয়দের প্রভাব সুস্পষ্ট।
রিজলের মতে, বাংলার মানুষের মধ্যে লম্বা ও গােল মাথার যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তা প্রমাণ করে যে, বাঙালি জাতি হলো দ্রাবিড় প্রভাবিত জাতি। তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে, মােঙ্গাল ও দ্রাবিড়দের রক্তের সংমিশ্রণের ফলে বাঙালিদের বাঙালি জাতি গঠনে মোঙ্গালীয়দের প্রভাব খুবই কম।
দ্রাবিড়, আদি অস্ট্রেলীয়, মােঙ্গালীয়, ককেশীয় ও আর্য ভাষাভাষী মানুষের আগমন :
এ কথা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বাঙালি জাতি একক কোনাে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা তৈরি হয়নি। অষ্ট্রিক ভাষাভাষী তারপর এদেশে আগমন ঘটে আর্য ভাষাভাষী মানুষের । নৃতাত্ত্বিক ভাষায় অস্ট্রিক ভাষাভাষী লােকদের প্রাক-প্রাবিড় বা আদি অস্ট্রাল বলা হয়। অস্ট্রেলিয়ার অদিম অধিবাসীদের সাথে এদের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। এসব জাতি গােষ্ঠীর মানুষ এদেশে আগমন করে এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে এবং ভাষার মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে এবং আস্তে আস্তে বাঙালি জাতি তৈরি হয়।
মােঙ্গাল ও দ্রাবিড়দের সংমিশ্রণ :
প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী হার্বার্ট রিজলের মতে, মােঙ্গালীয় ও দ্রাবিড়দের সংমিশ্রণের ফলে বাঙালি। জাতি তৈরি হয়েছে। মোঙ্গলীয় নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশ মানুষই হচ্ছে চাকমা। ধারণ করা হয় যে, আরাকানি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক আন্তঃবিবাহের কারণে চাকমা জাতির উৎপত্তি হয়েছে। রিজলের মতে বাঙালি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, চট্টগ্রামের মগ, রংপুরের রাজবংশী, কোচ নরগোষ্ঠীর লোকেরা একই প্যায়ভুক্ত।
মােঙ্গলীয় ও আদি অস্ট্রেলীয়দের সংমিশ্রণ :
বাংলার উত্তরাংলে বসবাসকারী ‘পোলিও’ নামে পরিচিত সম্প্রদায় প্রধানত মােঙ্গলীয়। এবং একই সাথে তাদের মধ্যে কিছুটা অস্ট্রেলীয় প্রভাবও আছে। বাংলায় বসবাসকারী গারো, হাজং, কাচারি, টিপ উপজাতিরাও তাদের মধ্যে কিছুটা অগারাে উপাদানও রয়েছে।
আরও পড়ুন >> সংবিধানের সংজ্ঞা দাও। উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর
আলপীয়দের বাংলায় ও উড়িষ্যায় আগমন :
বাংলাদেশের বাঙালি জাতি আলপীয়দের প্রভাবে প্রভাবিত জাতি। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে যে নিষাদ’ জাতির কথা বলা হয়েছে তাদের গায়ের রং ছিল কালো। তাদের আচারব্যবহার ও ভাষা ছিল অন্তত। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, নিষাদরা আদি ও স্ট্রাল গোষ্ঠীর কোনাে উপজাতি। বাংলাদেশের সাঁওতাল, মহালি, লোধা, ভূমিজ প্রভৃতি আদিবাসীরা এ গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে আলপীয়রা বাংলা ও উড়িষ্যায় আগমন করে বসবাস শুরু করে এবং বাঙালি জাতি গঠনে অবদান রাখে।
মুসলিম প্রভাব বিশিষ্ট জাতি :
নবম শতকে এদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হলে এদেশে অনেক তুর্কি, আফগান, মুঘল, আরবি ও ইরানিদের আগমন ঘটে। তারা ধর্ম প্রচারের জন্য এদেশে আগমন করলেও তাদের অনেকেই এদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যান স্বাভাবিকভাবেই উন্ত মুসলমানদের প্রভাব এদেশের মানুষের মধ্যে পড়েছে। এছাড়াও এদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হওয়ার পর অনেক মূসলমান ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এদেশে আগমন করেন এবং জাতি উৎপত্তিতে অবদান রাখে।
উপসংহার :
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়েছে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্দেশ্যে এদশে নানা গােষ্ঠীর মানবজাতি আগমন করেছে। এসব জাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও আর্য ভাষাভাষীর মানবগোষ্ঠী। এরাই তৎকালীন যুগে ভারতবর্ষে এসে বসবাস শুরু করে এবং এদেশে বাঙালি জাতির উৎপত্তিতে অবদান রাখে। এছাড়াও ইসলাম প্রচারে ও বাঙালি জাতির উৎপত্তিতে অবদান রেখেছে।