প্রশ্ন:- একনায়কতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর অথবা Discuss the main features of dictatorship অথবা, একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকা
একনায়কতন্ত্র হলাে গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়। সেই থেকে বর্তমান পর্যন্ত অনেক দেশে এ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। একনায়কতন্ত্র শধু একজন ব্যক্তির শাসন তা নয়, একজন ব্যক্তি অথবা এক গােষ্ঠী অথবা এক দলের শাসনও হতে পারে। একনায়কতন্ত্রের সমর্থক ব্যক্তি বা দল অত্যন্ত শক্ত শৃঙ্খলার বন্ধনে আবন্ধ থাকে। একনায়কতন্ত্রের কিছু বিশেষত্ব থাকে যেমন প্রত্যেক ব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান।
একনায়কতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর
অধ্যাপক ফাইনার এবং অটো স্ট্যামার একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। নিম্নে এসব বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলাে :
১. একক নেতৃত্ব :
একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এক’ নেতা। নেতা তার সমর্থক বা অনুসারীদের সাথে একাত্ব হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে শাসক জনগণের উর্ধে অবস্থান করেন। একনায়কতন্ত্র জনগণের বাধ্যগত আনুগত্য দাবি করেন। তিনি জনগণের নিকট দায়ী থাকেন না।
২. একমাত্র রাজনৈতিক দল :
একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে সেখানে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে। দলের কাঠামাে হবে স্তরভিত্তিক এবং একটি নির্দিষ্ট নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। দল পরিচালনার ভার ন্যস্ত থাকে মুষ্টিমেয় কন্দ্রীয় নেতার হাতে।
৩. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা :
একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনীতি কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত থাক। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কিত সব রকম প্রতিবেদন তথ্য ও উপাত্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
৪. জনগণকে ভীতি প্রদর্শন :
একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্বের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণকে ভীতি ও চাপের মধ্যে রাখা হয়। যাতে সরকারের বিরােধী কোনাে শক্তির উত্থান না হয়। এ কারণে বর্বর ও নির্মম শােষণ ও শাসন
পরিচালনা করা হয়।
৫. সামরিক খাত :
সামরিক খাতের উপর একনায়কের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিদ্যমান থাকে। তারা মনে করে সামরিক খাতে প্রভাবশালী হতে পারলে সরকার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। অন্যথায় সরকারের স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
৬. আদর্শবাদ :
একনায়কতন্ত্রে একটি জনপ্রিয় বিষয়ক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তখন ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা বর্ণ, আর এর মাধ্যমে উগ্রতার বিস্তার করে। এই এক আদর্শই রাষ্ট্রের সকল বিভাগও কার্যে প্রভাব বিস্তার করে।
৭. প্রশাসনিক ব্যবস্থা :
সরকার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য একনায়ক পুলিশ, গােয়ন্দা বাহিনীকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেন এভাবে পুলিশ ও গােয়েন্দা বাহিনীকে এক ধরনের সন্ত্রাসবাদী বাহিনীতে পরিণত করা হয়। এর মাধ্যমে সরকার বিরােধীদের অবাঞ্চিত মনে করা হয়।
৮. প্রচার মাধ্যমের অবস্থা :
প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা সরকারের টিকে থাকার পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এ কারণে একনায়ক প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতাকে কখনো মেনে নিতে পারেন না। প্রচার মাধ্যম সবসময় সরকারের চাপের ওপর থাকে ।
৯. নেতার প্রাধান্য :
একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতার প্রাধান্য লক্ষণীয়। নেতাকে জনগণের উধ্ধ্ব কোনাে ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইতালিয় ফ্যাসিস্ট দলের নীতি ছিল, “To believe, to obey and to fight.” অর্থাৎ নেতাকে বিশ্বাস করতে হবে, মান্যে করতে হবে এবং নেতার আদেশে যুদ্ধ করতে হবে।
আরও পড়ুন >> উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার কারণ বর্ণনা কর
১০. ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নেই :
একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার কোনাে স্বতন্ত্রকরণ নেই। সকল ক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে। এবং নেতাই তার ইচ্ছামত আইন, শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করবেন।
১১. ইউটোপিয়ালিজম :
একনায়কতান্ত্রিরবাদীরা বিশ্বাস করে, তাদের লক্ষ্য ও আদর্শ যেদিন সার্থকতা লাভ করবে তখন থকে মানবজীবনে সুখ ও শান্তি নেমে আসবে। এই বিশ্বাসকে ইউটোপিয়ালিজম বলে একনায়ক সবসময় এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী থাকে।
১২. নামমাত্র আইনসভা :
একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা উপস্থিত থাকে। এর বিভিন্ন কাঠামাে ও কার্যক্রম থাকলেও এসব নামমাত্র। সবকিছু মূলত একনায়কের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাস্তবায়ন হয় থাকে।
১৩. আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরোধী :
আন্তর্জাতিকতা সবসময় উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপরীতে অবস্থান, করে
একনায়কতন্ত্র টিকে থাকে উগ্র জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে। একারণে একনায়কতন্ত্র আন্তর্জাতিকতার বিরোধী।
১৪. উগ্র জাতীয়তাবাদী :
একনায়কতন্ত্র টিকে থাকার জন্য সবসময় উগ্র জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভর করে থাকে। এর মাধ্যমে বেশিরভাগ মানুষকে সাম্রাজ্যবাদী চিন্তায় অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষমতার মসনদকে পাকাপােক্ত করা যায়।
১৫. বুদ্বিবৃত্তি ও যুক্তিবিরােধী :
যেকোনাে একনায়ক শাসনব্যবস্থায় মুক্ত বুদ্ধিচর্চা ও যুক্তিবাদ নির্দিষ্ট থাকে। কেননা যুক্তিবাদ সবসময় থাকে। একনায়কতন্ত্রের বিপরীতে, একনায়কদের সিন্ধান্তের দুর্বতা খুঁজে করে। ফলে শাসকগণ যুক্তিতিবাদ ও মুক্তিবৃন্ধি চর্চাকে চাপিয়ে রাখে।
১৬. শৃঙ্খলা ও আনুগত্য :
একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলাে সেখানে আনুগত্য শৃঙ্খলায় উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। নেতার অপেক্ষা সমাজের সকল পর্যায়ে একই পন্থায় কার্যকর থাকে। ফলে শাষকগন যুক্তিবাদ ও মুক্তিবুদ্ধি চর্চাকে চাপিয়ে রাখে।
উপসংহার :
উপর্যুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, একনায়কতন্ত্র আদিমকালের রাজনৈতিক কাঠামাের সবচেয়ে বেশি চর্চাকৃত ব্যবস্থা হলেও বর্তমান আধুনিক সভ্যসমাজে এর প্রহণযােগ্যতা ক্রমাম্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। মত প্রকাশ, মুক্তবৃ্ধি চর্চা, গণতন্ত্রের গ্রহণযােগ্যতা দুততার সাথে হারাচ্ছে। তবে বর্তমানে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের যুগে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলােতে কখনাে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্থায়ী হতে পারে না।