প্রশ্ন : রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দাও। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর। অথবা, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলের কার্যাবলি আলােচনা কর।
ভূমিকা
আধুনিক গণতন্ত্র হলাে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। বর্তমান সময়ে বিশালায়তনের রাষ্ট্রগুলোর বিপুল জনগোষ্ঠীর পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। বর্তমানে তাই জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের মাধ্যসে পরোক্ষভাবে শাসকার্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। এ নির্বাচনকার্য সম্পন্ন হয় দলীয় ভিত্তিতে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হলাে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল হচ্ছে আধুনিক গণতন্ত্রের প্রাণ।
রাজনৈতিক দল কি
সাধারণভাবে রাজনৈতিক দল বলতে একটি সংঘবদ্ধ জনসমষ্টিকে বুঝায়, যারা রাষ্ট্রের সমস্যাবলি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন করে নির্দিষ্ট নীতি বাস্তবায়ন করতে চায়। অর্থাৎ যখন কিছু সংখ্যক মানুষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় একমত পােষণ করে এবং ন্যুনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবন্ধ হয়, তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলে। রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হলাে জনমত সংগ্রহ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
অধ্যাপক ম্যাকাইভার বলেছেন,
Political association organised in support of some principles or policies which by constitutional must it endavours to mark the determinant of government.
অর্থাৎ যারা কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সাংবিধানিক উপায়ে সরকার গঠন করতে সচেষ্ট হয় তাকে রাজনৈতিক দল বলা হয়।
এডমন্ড বার্ক বলেন,
যখন কোনো জনসমষ্টি কোনাে নির্দিষ্ট স্বীকৃতি নীতির ভিত্তিতে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সর্বসাধারণের কল্যাণ সাধনের জন্য সংঘবন্ধ হয় তখনই একটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়।
সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলাে হচ্ছে এমন একট জনসমষ্টি যারা রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের পন্থায় জনসম্মুখে প্রচারের মাধ্যমে জনসমর্থন লাভ কর এবং ক্ষমতা দখল ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন করে।
রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও কার্যাবলি
আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও কার্যাবলি বহুবিধ হতে পারে। আর এসব কার্যাবলির মাধ্যমেই দল ব্যবস্থার অস্তিত্বের অপরিহার্যতা নিহিত আছে। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও কার্যাবলি সম্পর্কে নিম্নে আলােচনা করা হলাে :
১. সমস্যা নির্ধারণ :
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা জটিল এবং বিচিত্র ধরনের। এসব সমস্যা আবশ্যক, সংগঠিত জনসাধারণের পক্ষে তা আনুধাবন করা সম্ভব হয় ন। সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোই সমস্যা নির্ধারণের গুরুদায়িত্ব পালন করে।
২. নীতিনির্ধারণ ও কর্মসূচি প্রণয়ন :
রাষ্ট্র প্রধান সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোে নিরসনকল্পে দলীয় নীতিনির্ধারণ এবং সুসম্পর্ক ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রণয়ন করা রাজনৈতিক দলের মুখ্য কার্য। রাজনৈতিক দলের নেতারা সে নীতি ও কর্মূচ নির্ধারণ করলে দলের সভায় তা গৃহীত ও অনুমোদিত হয়।
৩. দলীয় নীতি প্রচার ও জনমত গঠন :
রাজনৈতিক দল দলীয় নীতি ও কর্মসূচি নির্ধারণ করলে দলের সভায় তা গৃহীত ও রাজনৈতিক দল দলীয় নীতি ও কর্মসূচি প্রচারের ব্যবস্থা করে জনসমর্থন তাদের অনুকূলে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালায়। এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দল জনগণের সাথে যােগাযােগের সব মাধ্যমকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়। জনগন অনুষ্ঠান, সংবাদপত্রে বিবৃতি দান, পুস্তিকা সংকলন ও বিতরণ, নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন দান ইত্যাদি উপায়ে রাজনৈতিক দল জনমত সংগঠনে ব্যাপক সাহায্য করে। জনসাধারণ বিভিন্ন দলের কর্মসূচি ও কর্মপন্থা পর্যালােচনা করে সুষ্ঠ মতামত গঠন জনগণ করতে সক্ষম হয়।
৪. প্রার্থী মনােনয়ন :
রাজনৈতিক দল সরকারের প্রায় সব নির্বাচিত পদে প্রাথী মনােনীত করে তাদের পক্ষে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করে। এ রাজনৈতিক দলের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ নির্বাচন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় যাওয়ার নিয়মতান্ত্রিক সুযােগ প্রদান করে। সব দলই সম্ভবপর যোগ্যতম ও জনপ্রিয় প্রাথী মনােনয়ন চেষ্টা করে। তাছাড়া নিজেস্ব নির্বাচনি ব্যয়
মিটানাের মত আর্থিক সংগতি প্রার্থীর না থাকলে, রাজনৈতিক দলই তার সে ব্যয় বহন করে থাকে।
৫. নির্বাচনি প্রচার চালানাে :
রাজনৈতিক দলগুলাো নিজেদের প্রার্থীদের নির্বাচনে বিজয়ী করানোর জন্য সারা দেশে ব্যাপক প্রচার কার্য চালায়। তারা নিজেদের প্রার্থীদের সবচেয়ে যোগ্য প্রতিপক্ষ করতে সচেষ্ট হয়। অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে ভোটারদের কাছে দেশের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে। সে সাথে দলগুলা ক্ষমতায় যেতে পারলে কিভাবে তাদের সমস্যা সমাধান করবে, তাও তারা জনগণকে বুঝিয়ে বলে। তখন দলগুলাের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি
জনগণের বিশেষ দৃষ্টি লাভ করে।
৬. সরকার গঠন :
নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে। তাছাড়া নির্বাচনের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে মনােনিবেশ করে। দলীয় আদর্শের প্রতিশ্রুতি পালনে মনানিবেশ করে। দলীয় আদর্শের সাথে সংগতি রেখে নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রত্যেক রাজনতিক দল গুরত্বপূর্ণ ভূৃমিকা পালন করে। কেননা তারা জানে জনগণই প্রকৃত ক্ষমতার উৎস। দলীয় নেতৃবর্গ সরকার গঠনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দান করে জাতীয় স্বার্থ অর্জন করতে যত্নবান হয়।
৭. বিরােধী দলের ভূমিকা পালন :
যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে সরকার গঠন করার মতাে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় না যেসব রাজনৈতিক দল সাধারণত বিরোেধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এসব বিরোধী দল সরকারি ক্রিয়াকলাপের ত্রুটিবিচ্যুতি জনসমক্ষে প্রকাশ করে জনমত সংগঠনে আদিষ্ট থাকে।
৮. দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা :
রাজনৈতিক দলের ভূমিকা হলাে তার সবদলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দল তার দলীয় কর্মীদেরকে দলীয় নীতিতে উদ্ভুদ্ধ করে দলের প্রতি গভীর আনুগত্য প্রকাশে ব্রতী রাখে এবং বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
আরো পড়ুন>> বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচয় দাও
৯. সংযােগ সাধন :
যেসব রাষ্ট্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি কমবেশি প্রযােজ্য সেসব রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ঐক্য সাধনের প্রচেষ্টা চালায়। এ ব্যক্তি ও সরকারের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপনের মিলনসেতু। এর মাধ্যমেই ব্যক্তিগণ তাদের সমস্যা ও অভাব অভিযােগ সরকারের নিকট তুলে ধরে এবং সরকার সেগুলাে অবহিত হয়।
১০. স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অন্দোলন পরিচালনা :
আঞ্চলিক ক্ষেত্রে স্বাধিকার আদায়ের জন্য এবং পরাধীন দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যে রাজনৈতিক দল আন্দোলনের সূচনা করে এবং আন্দালনের মাধ্যেমে দাবি আদায়ের প্রচেষ্টা চালায়। যেমন – ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের নেত্বত্ব।
১১. সরকারের স্থায়িত্ব :
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দল প্রথার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। ফলে সরকারের পিছনে সর্বদা পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্যের সমর্থন বজায় থাকে। স্থায়িত্বের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা থাকে না।
১২. স্বার্থের গ্রন্থিকরণ :
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকার স্বার্থান্বষী গােষ্ঠী রাজনৈতিক দলগুলাের মাধ্যমে নিজেদের দাবি সরকারের নিকট উপস্থাপিত করে, এভাবে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে স্বার্থের গ্রন্থিকরণ সম্পন্ন হয়।
১৩. দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধ সৃষ্টি :
রাজনৈতিক দলগুলাে দেশের বিশৃঙ্খলার মধ্যে শৃঙ্খলা আনে। এতে জনগণের মধ্যে ঐক্য জাগ্রত হয়। দল ব্যবস্থা, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবােধ এবং দেশপ্রেম সৃষ্টি হয়।
১৪. গণতেন্ত্র স্বরূপ বজায় রাখা :
রাজনৈতিক দলপুলাে গণতান্ত্রিক শাসনের স্বরূপ বজায় রাখে। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসন দলীয় শাসনে পরিণত হয়েছে। তাই এখন দল ব্যবস্থা
গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ । দল শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠূভাবে পরিচালিত হওয়া অসম্ভব। দলপ্রথাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রকে ভাবা যায় না।
উপসংহার
উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও কার্যাবলি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য এবং প্রতে্যেক বৃহৎ স্বাধীন রাষ্ট্র এদের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী। তবে পৃথিবীর সব দেশে রাজনীতি সমান ভূমিকা পালন করে না। বিভিন্ন আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও কার্যাবলি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।