প্রশ্ন : জনমতের সংজ্ঞা দাও। জনমত গঠনের উপাদানসমূহ আলােচনা কর। অথবা, জনমত কি? জনমত গঠনের উপাদানসমূহ আলােচনা কর। অথবা, জনমত গঠনের মাধ্যমগুলাে লেখ।
ভূমিকা
জনগণ কোনাে নির্দিষ্ট বিষয়ে যে মতামত প্রকাশ করে তাই হলাে জনমত। জনমতের অবিরাম ক্রিয়াকলাপকে গণতন্ত্রের গতিশীলতার লক্ষণ বলে অভিহিত করা হয়। মানুষ যে পরিবেশে বড় হয় এবং যভাবে তার সামাজিকীকরণ হয় সেই দূঢ় ভিত্তির ওপর তার মতামত প্রতিষ্ঠিত হয়। জনমত প্রকাশের মাধ্যমসমূহ জনমত গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ সৃষ্টিকোণ থেকেই বলা হয় যে,
Public opinion is what its media make it to be. অর্থাৎ, বাহন যা করে তাই জনমত।
জনমত কি
সাধারণভাবে বলা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতই হলো জনমত। জনমতের একটি সংজ্ঞা হলাে কোনাে জনগােষ্ঠীর সবার মতামত, এমনকি সংখ্যালঘুর মতামতও এতে থাকতে পারে। কোনাে সময়কার ব্যাপক আলােচিত বিষয় সম্পর্কে গােটা জনগণ বা তার বৃহত্তর অংশ যে ধারণা পােষণ করে তাই হচ্ছে জনমত। তবে জনমত সম্পর্কিত কোনাে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা
মরিস জিন্সবার্গ এর মতে,
জনমত বলতে বুঝায় বিভিন্ন জনের মতামতের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি এক সামাজিক ফসল। Public opinion is a social product due to the interaction of many friends.
মার্কিন মনােবিজ্ঞানী কিম্বল ইয়ং এর মতে,
জনগণ নির্দিষ্ট সময়ে যে মতামত প্রকাশ করে তাই জনমত। Publie opinion consists of the opinion held by a public at a certain time.
লর্ড ব্রাইস এর মতে,
জন সম্প্রদায়ের কল্যাণ সম্পর্কে জনগণের মতামতের সমন্টিকে সাধারণত জনমত বলা হয়। Public opinion is commonly used to denote the aggregate of the views men hold regarding matters that offiece or interest the community.
জন স্টুয়ার্ট মিল এর মতে,
কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় সমস্যার ওপর জনগণের সংগঠিত অভিমতের নাম জনমত। Public opinion means the opinions of the majority of the peple expressed on a national issue.
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমত গঠনের উপাদানসমূহ
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমত গঠনের উপাদানসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলো :
১. মুদ্রণযন্ত্র :
জনমত গঠন ও প্রকাশে মুদ্রণযন্ত্র এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বিভন্ন ধরনের মুদ্রণযন্ত্র যেমন সংবাদপত্র, সাহিত্য, পুস্তকপুস্তিকা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক, অর্থনৈতিক তথ্যাদি জনসম্মুখে হাজির করে যার ওপর ভিত্তি করে জনমত গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গানের গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রচার করে জনগণ দেশবিদেশের বিভিন্ন বিষয়ে জানার সুযােগ পায়।
২. বেতার, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন :
বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। বেতার, টেলিভিশনের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত সর্বশেষ খবর দেশের সর্বত্র ত্বরিত গতিতে পৌছে দওয়া হয়। জনগণের মধ্যে বেতার ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেতার, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রাজনৈতিক ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। রেডিও টেলিভিশন গণ-সংযাগের এ মাধ্যমগুলাের সাহায্যে দেশ-বিদেশের নানা তথ্য সম্পর্কে জনসাধারণ অবহিত হতে পারে টেলিভিশন বিভিন্ন তথ্যচিত্র, নানা বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য ও সংবাদ ভাষ্যে পরিবেশনে করে এবং জনমত গঠনে সাহায্য করে রেডিও টেলিভিশন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলােচনা, টক-শাে আয়ােজন করে যা জনগণকে প্রভাবিত করে এবং যথােপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
প্রতিদিনের আপডেট পেতে আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন >>
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান :
যথােপযুক্ত জনমতগঠনের অন্যতম উল্লেখযােগ্য মাধ্যম হলাে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিদিস্ট পাঠকদের সাথে দেশের সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলােচনা করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেকচার, সেমিনারের আয়ােজন করা হয়। তাই সব মিটিং বা সেমিনারে বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় অভিজ্ঞ ব্যক্তিগত লেখক উপস্থিত থাকেন এবং তাদের মতামত শিক্ষাথীদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করা হয়। স্কুল-কলেজের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা ছাত্রছাত্রীদের ওপর এক স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক জ্ঞান, গণতন্ত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে।
৪. সভাসমিতি :
প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের বিভিন্ন ধরনের সংস্থা গঠনের জন্য সভাসমাবেশ আয়োেজন করার অধিকার ও পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এসব সভাসমিতিতে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যা জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে। সভাসমিতি ও সমাবেশের মাধ্যমে সুদূর গ্রামাঞলে শিক্ষিত অশিক্ষিত ধনী-দরিদ্র নির্বিশষে সবার কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ দেশের সাময়িক বিভিন্ন সমস্যা তার প্রকৃতি এবং সমাধানের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করে। এসব আলোচনা সমালােচনার ভিত্তিতে নিজ নিজ মতামত গঠন করে। আবার, সভাসমিতির মাধ্যমে জনগণ নিজেস্ব মতামতও প্রকাশ করতে পারে।
৫. রাজনৈতিক দল :
স্বতন্ত্র আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রধান উদ্দেশ্য নিজেদের সমর্থনে জনমত গঠন করে নির্বাচনে জয়লাভ করা এবং শাসন ক্ষমতা দখল করা। রাজনৈতিক দলগুলাে বিভিন্ন সভা মিছিলের আয়ােজন করে এবং তারা তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সফলতা, ব্যর্থতা সম্পর্কে জনগণকে অভিহিত করে। দেশের বহুবিধ সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে জনগণকে জাগ্রত করে। দেশের বহুবিধ সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্ন দলের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে জনসাধারণ নিজ নিজ মতামত গঠন করে এবং নির্বাচনের প্রাককালে তা ব্যক্ত করে।
৬. আইনসভা :
আইনসভা জনমতের বাহন হিসেবে কাজ করে এবং জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে আইনসভা গঠিত হয়। আইনসভার প্রতিনিধিদের (সরকারি ও বিরােধী) দলগুলাের তর্কবিতর্ক, প্রশ্নোত্তর সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিধিদের মতামত জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে। জনগণ সংবাদপত্র, বেতার প্রভৃতি প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে আইনসভার কার্যবিবরণী সমভাবে অবহিত তারা দেশের বহুবিধ সমস্যার প্রকৃতি, সরকারি কার্যক্রম প্রভূতি উপলব্ধি করে আপন মতামত গঠন করে।
আরও পড়ুন >> চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ভূমিকা বা কার্যাবলি আলােচনা কর
৭. পরিবার :
পরিবার হলাে জনমত গঠনের প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বা বাহন। পরিবারকে মানবজীবনের আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় বলা হয়।প্রকৃতপক্ষে মানুষের বিকাশ ও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া তার পরিবার থেকেই সূচিত হয়। পরিবারের সদস্যদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, ধ্যানধারণা ও আশা-আকাঙফার প্রতিফলন ঘটেপ রিবারের অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ মতাদর্শ ওধ্যা নধারণা শিশু ও কিশোার মনকে প্রভাবিত করে। পরিবারের মূল্যবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সদসদের বিশেষভাবে প্রতাবিত করে। এপ্র ভাব ভবিষ্যতে রাজনৈতিক মতামত গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়। অধিকাংশ পরিবারে বাবা যে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে সন্তানও সে দলকে সমর্থন করে পরিবারের মধ্যে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যেমন রাজনৈতিক বিষয়, সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে আলাোচনা করা হয়। এ আলোচনার মাধ্যমে পরিবারের শিশু ও কিশোর সদস্যদের রাজনৈতিক মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে।
৮. ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পারস্পরিক আলাপ আলােচনা :
বিভিন্ন প্রকার ধমীয় অনৃষ্ঠান ও পারস্পরিক-আলাপ আলােচনার মাধ্যমে জনমত গঠিত ও বিকশিত হতে পারে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় সংঘগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধর্মীয় সংঘগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আলােচনায় অংশ নেয়। ধর্মীয় সংঘগুলোর আলােচনা বা উপদেশ জনগণকে অনেকটা প্রভাবিত করে। এলমন্ড ও পাওয়েল বলেন,
ধর্মীয় সংঘের কার্যকলাপের ফলে মানুষের রাজনৈতিক জ্ঞান বৃদ্ধি পায়।
৯. চাপসৃষ্টিকারী বা স্বার্থকামী গোষ্ঠী :
সাধারণত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা স্বার্থকামী গােষ্ঠীসমূহ নিজেদের পেশা বা বৃত্তিগত সুযোগ সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করলেও কোনাে কোনাে সময় জনমতকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানাের চেষ্টা করে। যেহেতু জনমতের চাপ অপ্রতিরোধ্য এবং সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারদর্শী তাই তারা জনমতকেই হাতিয়ার, হিসেবে ব্যবহার করে। রাষ্ট্র কোনো সিদ্ধান্ত যখন কোনাে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী নিজেদের জন্য ক্ষতিকর মনে করে তখন তারা জনগণকে ক্ষেপিয়ে তালে এবং এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে।
১০. ভােটদান প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে :
সমগ্র নির্বাচনি প্রক্রিয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ভােটদানের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও জনমতে গড়ে ওঠে। বরং এ সময় জনমত সুগঠিত হয় এবং নির্দিষ্টরূপে আত্মপ্রকাশ করে শক্তির জোরের পরিবর্তে চাই যুক্তির জোর। যুক্তির জোর প্রমাণে সুসংগঠিত জনমতই একমাত্র মাধ্যম। ভােটদান পদ্ধতি অন্যসব পদ্ধতির ছাকনি হিসেবে জনমতকে পরিমাপ করে থাকে।
উপসংহার
উপরোক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভােট এমনই এক যুদ্ধ যাতে জিততে হলে জনমত আপনা আপনি সংগঠিত বা বিকশিত হতে পারে না। সুষ্ঠু জনমত গঠন ও প্রকাশের জন্য একদিকে যেমন জনমতের মাধ্যমগুলাের প্রয়ােজন, তেমনি মতামত গঠন ও প্রকাশের উপযােগী পরিবেশ সৃষ্টিরও প্রয়ােজন। মূলত জনমত গঠনের জন্য উপরিউক্ত মাধ্যমগলাে অপরিহার্য। জনমত গঠনে একক কোনাে মাধ্যম যথেষ্ট নয়। সবগুলো মাধ্যমের যথাযথ কার্যকারিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সুষ্ঠ ও সুদূঢ় জনমত গড়ে ওঠে।