প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কী? যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর। অথবা, What is the federal government? Discuss the characteristics of federal government অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাকে বলে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।
ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্র হলাে জাতীয় ঐক্যের সাথে অঙ্গরাজ্যের অধিকারের সমন্বয় সাধনের একটি রাজনৈতিক উপায়। যুক্তরাস্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর কতিপয় উপাদান বা বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এসব বৈশিষ্টের কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা থেকে পৃথক রয়েছে। তবে উভয় সরকার স্ব স্ব ক্ষেত্র স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং স্বাতন্ত্র্য ক্ষমতা ভােগ করে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার
আধুনিক ধারণায় যুক্তরাস্ট্রকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র হলাে এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে একটি সাধারণ সরকার ও কতকগুলোে আঞলিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা এমনভাবে বন্টন করা হয় যে, তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে পরস্পরের পরিপুরক হিসাবে কাজ করে এবং প্রশাসনিক প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে জনগণকে শাসন করে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত রয়েছে। বেশির ভাগ উন্নত দেশসমূহে এউ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত রয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে এই শাসনব্যবস্থা দেখা যায়।
আরও জানতে ক্লিক করুন >>
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলাে :
১. দুধরনের শাসন :
একটি কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে কতিপয় আঞ্চলিক সরকার নিয়ে গঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার। আঞ্চলিক সরকারের ওপর নিজ নিজ এলাকা বা রাজ্য শাসনের দায়িত্ব ন্যন্ত থাকে, অপরদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার সমগ্র দেশ শাসন করে। কেন্দ্রীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। কেন্দ্রানুগ শক্তি (Centripetal foroe) এর জন্য অর্থাৎ জাতীয় ঐক্যের প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের সৃষ্টি হয়।
২. ক্ষমতার বণ্টন :
ক্ষমতার বণ্টন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সাধারণত জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। আবার আঞ্চলিক স্বার্থযুক্ত বিষয়সমূহের ক্ষমতা থাকে। আবার আঞ্চলিক স্বার্থযুক্ত বিষয়সমূহের ক্ষমতা থাকে আঞ্চলিক সরকারের হাতে।
৩. শাসনতন্ত্র :
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধান বা শাসনতন্ত্র লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় হয়। সংবিধানে কেন্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি লিপিবদ্ধ থাকে। এ কারণে সংবিধান লিখিত হওয়া প্রয়ােজন। অপরদিকে, চাইলেই কোনাে শাসক শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন করে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে না। তাই পরিবর্তন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল।
৪. শাসনতন্ত্রের প্রাধান্য :
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় সংবিধান বা শাসনতন্ত্র হলাে ক্ষমতার একমাত্র উৎস। সংবিধানে সকল সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি লিপিবন্ধ থাকে। সংবিধানকে সহজে পরিবর্তন করা যায় না। সংবিধানকে অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আঞলিক সরকারসমূহ নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে থাকে।
৫. দ্বি-নাগরিকত্ব :
দ্বি-নাগরিকত্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্রের সকল নাগরিক প্রথমে তার নিজ আঞ্চলিক সরকারের বা অঙ্গরাজ্যের নাগরিক, আবার কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নাগরিক। ব্যতিক্রম হিসেবে ভারতে দ্বি-নাগরিকত্ব ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়নি। এছাড়া অন্যান্য সকল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় দ্বি-নাগরিকত্বের বিধান রয়েছে।
৬. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা :
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বিদ্যমান। নিম্নকক্ষ গঠিত হয় সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা। অপরদিকে, উচ্চকক্ষে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্য থেকে সমপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সদস্য থাকে। জনগণ, ভৌগোেলিক অবস্থান, প্রকৃতি প্রভূতি বিষয়ের বিবেচনা করে সমপ্রতিনিধি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানাে হয় না।
৭. স্বতন্ত্র সংবিধান :
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যসমূহের সতন্ত্র সংবিধান থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলী লিপিবদ্ধ থাকে কেন্দ্রীয় সংবিধানে। অপরদিকে আঞ্চলিক সরকারের সংবিধান আঞ্চলিক সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি লিপিবন্ধ থাকে।
৮. দুই ধরনের আইন :
কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার জন্য থাকে কেন্দ্রীয় আইন, অপরদিকে, রাজ্য সরকার পরিচালনার জন্য থাকে রাজ্য আইনসভা প্রণীত আইন। জনগণকে উভয় ধরনের আইনকে মান্য করে চলতে হয়।
৯. দ্বৈত বিচারব্যবস্থা :
দ্বৈত বিচারব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। কেন্দ্রীয় সরকার বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হয় কেন্রীয় সরকারের আইন দ্বারা। আবার রাজ্য সরকারের বিচারকার্য পরিচালনা করা হয় রাজ্য সরকারের আইনের মাধ্যমে।
১০. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত :
যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বা (Federal Court) যুক্তরাষ্ট্রের অপর এক বৈশিষ্ট্যে। সংবিধানের ব্যাখ্যা, কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক সরকারসমূহের মধ্যে সম্ভাব্য বিরোধের মীমাংসা প্রভৃতি দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতের অস্তিত্ব প্রয়ােজন। যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয়কে সংবিধান অভিভাবক ও সংরক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে।
১১. দ্বৈত আনুগত্য :
দ্বৈত আনুগত্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য একজন নাগরিক প্রথমে তার রাজ্য সরকারের আনুগত্য করতে বাধ্য। পরবর্তীতে আবার কেন্দ্রীয় সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করতেও বাধ্য থাকে।
১২. স্বায়ত্তশাসন :
এককেন্দ্রিক সরকার ও যুক্তরাস্ট্রীয় সরকারের মধ্যে বৈশিষ্ট্যাগত সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলাে স্বায়ত্তশাসন। যুক্তরাস্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন সকল আঞলিক সরকার স্বায়ত্তশাসন চর্চা করতে পারে।
১৩. কেন্দ্রুখী ও কেন্দ্রবিমুখী প্রবণতা :
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রাদেশিক সরকারসমূহের মধ্যে দুধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যথা : কেন্দ্রমুখী প্রবণতা এবং কেন্দ্রবিমুখী প্রবণতা। প্রাদেশিক বা আঞ্লিক সরকার কেন্দ্র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে, কিন্তু নিজের সার্বভৌমত্ব ও স্বায়ত্তশাসনের ব্যাঘাত ঘটাবে না।
১৪. বিচার বিভাগের প্রাধান্য :
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার সংবিধানের প্রাধান্য রক্ষা করতে গিয়ে বিচার বিভাগের প্রাধান্য সৃষ্টি করে। সংবিধানের প্রাধান্য, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয় সর্বোচ্চ বিচারালয়কে। এই বিচারালয় অঙ্গরাজ্যের কোনাে অপ্রাসঙ্গিক আইন প্রণয়নকে রােধ করে। এছাড়া বিচার বিভাগ সংবিধান বহির্ভূত যেকোনাে আইনকে বাতিল বা সংশােধন করতে পারে।
উপসংহার
উপরোক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উপরিউক্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ এর কারণে এক অনন্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব বৈশিষ্ট্যসমূহ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থাকে এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা থেকে সামঞ্জস্যতা প্রদান করেছে। তাই শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমুখী করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার কোনাে জুড়ি নেই।