প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্তসমূহ ব্যাখ্যা কর অথবা, Explain the prerequisites of federal system of government অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনের পূর্বশর্ত আলোেচনা কর।
ভূমিকা
বর্তমান যুগে যুক্তরাষ্ট্রই প্রকৃত শাষনব্যবস্থা হিসেবে গন্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র বলতে বুঝায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের এক সম্মিলনকে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রাভিগামী (Centripetal) ও কেন্দ্রবিগ (Centrifugal) এর উভয় শক্তির সমন্বিত উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এ দুই শক্তির সামঞ্জস্য বিধান সহজ কাজ নয় একারণে যুক্তরাস্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সাফল্যের কিছু পূর্বশর্ত আছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্তসমূহ
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্তসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলাে :
১. অঙ্গরাজ্যগুলাের মধ্যে সহযােগিতা :
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার সফলতার জন্য আঞ্চলিক সরকারগুলোর মধ্যে সাম্য ও সহযােগিতার সম্পর্ক থাকা প্রয়াজন। কোনাে বিশেষ অঙ্গরাজ্যের একক প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সফলতা কায়েম করা যায় না। তবে সহযোগিতার সম্পর্ক নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা আবশ্যক।
২. শক্তিসামর্থ্যের সামঞ্জস্য :
অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব কমানাের জন্য এর প্রভাব নিরসন করার জন্য প্রদেয় শক্তি সামর্থ্যের সামঞ্জস্য বিধান করা প্রয়ােজন। যদিও আয়তন, জনগণ, ভৌগোলিক কারন প্রভৃতি কারনে সাম্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তবে যতটুকু সম্ভব পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ করা নিরসনের মতো শক্তিসামর্থ্য সামঞ্জস্য করা প্রয়োজন।
৩. ভৌগোলিক নৈকট্য :
অঙ্গারাজ্যগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক নৈকট্য না থাকলে এদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। অঙ্গরাজ্যগুলোে যদি নৈকট্যে অবস্থান করে তাহলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠার সম্ভাবনা থাকবে, যেখানে থাকবে সহযােগিতা ও সাম্য। মার্কিন যুক্তরাস্ট্র, কানাডা, ভারত প্রতৃতি দেশে এই ভৌগােলিক সান্নিধ্য ব্যাপক অবদান রেখেছে।
৪. রাজ্যসমূহের আর্থিক সংগতি :
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকার জন্য, পারস্পরিক অঙ্গরাজ্যসমূহের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিরােধ করার জন্য অঙ্গরাজ্যসমূহের মধ্যে আর্থিক সংগতি বজায় রাখা প্রয়ােজন। বস্তুত অঙ্গরাজ্যগুলাের প্রয়ােজনীয় আর্থিক সংগতির অভাব এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্ররাজ্যের সুস্থ সম্পর্ককে বিপন্ন করতে পারে।
৫. সমজাতীয়তার মনােভাব :
বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, আচার আচরণ ও রীতিনীতিগত অভিন্নতা এবং সমজাতীয়তার মনােভাব যুক্তরাষ্ট্রের বণ্টনকে দৃঢ় করে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও সমজাতীয় মনোভাব অঙ্গরাজ্যগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের অনুকুল ভূমিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। এ সমজাতীয়তার মনাভাব যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের স্বার্থে অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. সমপ্রতিনিধিত্বের নীতি :
যুক্তরাস্ট্রে কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষে প্রতিনিধির সংখ্যা সমান করা হলে অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে সাহসের নিশ্চয়তা বাড়বে। আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এই সমপ্রতিনিধিত্বের নীতিকে মেনে নেওয়া বাঞ্চনীয়। এর মাধ্যমে অঙ্গারাজ্যগুলাের দাবিদাওয়া মেটানাে এবং ক্ষোভ নিরসন করা সহজ হয়।
৭. শাসনব্যবস্থার সাদৃশ্য :
বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যগুলাের মধ্যে শাসনব্যবস্থার সাদৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের জন্য জরুরি। অথবা অঙ্গরাজ্যগুলােতে সংঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে যা গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এ কারণে শাসনব্যবস্থায় বৈসাদৃশ্য না থাকা বাঞ্চনীয়।
৮. আদালতের ভূমিকা :
যুক্তরাস্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত কেন্দ্রের সাথে অন্যান্য আঞ্চলিক সরকারের বিরােধ মীমাংসা করে থাকে। তাই এই আদালত শক্তিশালী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্চনীয়। অন্যথায় যুক্তরান্ট্রীয় ব্যবস্থায় টিকে থাকা হুমকির মুখে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সফলতার জন্য তাই
আদালতের শক্তিশালী হওয়া বাঞ্চনীয়।
আরও পড়ুন >> সংসদীয় সরকারের সফলতার শর্তাবলি আলোচনা কর
৯. কেন্দ্রের পক্ষপাতহীনতা :
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার সফল হওয়ার জন্য কেন্দ্র সাথে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের সম্পর্ক যেমন সুষম হওয়া প্রয়াজন, সেই সাথে কেন্দ্র নিরপেক্ষ আচরণ করা বাঞ্চনীয় । আন্যথায় পক্ষপাতের কারণে বঞ্চিত অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাস্ট্র সরকার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
১০. রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার বিস্তার :
যুক্তরাস্ট্রীয় সরকার সাফল্যের জন্য নাগরিকদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকা প্রয়ােজন। সেই সাথে শিক্ষার বিস্তার সরকার ব্যবস্যায় সফলতাকে চুড়ান্ত রূপদান করতে পারবে। অন্যথায় দ্বায়িত্বহীন ও অসচেতন নাগরিক যুক্তরাষট্রের সফলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
১১. সামাজিক রীতিনীতি :
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজ্যগুলাের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি প্রভূতির মধ্যে মােটামুটি সামঞ্জস্য বিধান করা জরুরি। এর মাধ্যমে অনাতুত বিবাদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সফলতা পাওয়া যাবে।
১২. গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ ধারণ :
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা টিকে থাকা এবং এর সফলতার জন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সাধারণ জনগণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। অন্যথায় এ ব্যবস্থা সফল হতে পারবে না।
১৩. যোগ্য নেতৃত্ব :
যোগ্য নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্তসমূহ র মধ্যে একটি অপরিহার্য উপাদান। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার তার আবশ্যকতা আরও বেশি। কেননা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আঞ্চলিক সরকারসমূহের সামঞ্জস্য বিধান করে শাসন কাজ পরিচালনা করতে হয়। এ কারণে অধ্যাপক কে. সি হােয়ার (Orif, K. C. Where) যুক্তরাষ্ট্রীয় সাফল্যের জন্য যােগ্য নেতৃত্বের ওপর জোর দিয়েছেন।
১৪. সুস্থ দলব্যবস্থা :
সুস্থ দলব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সফলতার অন্যতম শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। অঙ্গরাজ্যে সুস্থ ও সংহত রাজনৈতিক দল থাকলে তা আঞ্লিক স্বার্থের জন্য যেমন উপকারী তেমনি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য উপকারী।
১৫. আইনের প্রতি শ্রদ্ধা :
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা সাফল্যের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলাে, আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। সাংবিধানিক আইন ও সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনগণকে সচেতন হতে হবে।
উপসংহার
উপযুক্ত আলাচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আলোচিত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্তসমূহ পালন করা প্রয়ােজন। যদিও দুরুহ কাজ, তবুও বিভিন্ন বিভিন্নভাবে এসব শর্ত পালনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা টিকে রয়েছে। এসব শর্ত পালনে আবার ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। একেক দেশে তাই একেক রকম যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র।