প্রশ্ন : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাস্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা আলােচনা কর। অথবা, নির্বাচকমন্ডলীর সংজ্ঞা দাও, আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা আলোচনা কর।
ভূমিকা
প্রাচীন কালে গ্রিক বা রোমে নগররাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হতাে সর্বসাধারণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে। নগররাষ্ট্র আয়তন ছোট এবং জনসংখ্যা ছিল কম, তাই একত্রে কোনাে একম্থানে মিলিত হয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করতাে। বর্তমানে রাষ্ট্রের আকার, আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন তা আর সম্ভব হয় না। ফলে নির্বাচকমণ্ডলীর আবির্ভাব হয়। বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নির্বাচকমন্ডলীর সংজ্ঞা
বর্তমানে যেকোনাে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকার, আয়তন ও জনসংখ্যা বহুল পরিমাণে বৃন্ধি পাওয়ার কারণে জনগণ একত্রে মিলিত হয়ে রাস্ট্র পরিচালনার নীতি পূর্বেরমতাে নির্ধারণ করতে পারে না ফলে জন্ম নিয়ছে প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা। প্রতিনিধির মাধ্যমে নাগরিকগণ পরােক্ষভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় অংশ নেয়। রাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকগণ ভােট প্রদানে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। বিভিন্ন রাস্ট্রে ভােটদানের বয়স বিভিন্ন রকম। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে ভাটদানের বয়স ১৮ বছর। অবশ্য পাগল, উন্মদ ও দেউলিয়া হলে ভােটাধিকার থাকে না। ভােট প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ আবার প্রকাশ্য বা গােপন হতে পারে। বর্তমানে
ব্যালট দ্বারা গোপন ভোট সর্বত্র প্রচলিত। ভােটাধিকারপ্রাপ্ত সব নাগরিকের সমষ্টিকে নির্বাচকমণ্ডলী বলে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমন্ডলীর ভূমিকা
একটি রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর নানাবিধ কাজ করে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে
ত্বরান্বিত করে। নিম্নে আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. প্রতিনিধি নির্বাচন :
নির্বাচকমণ্ডলীর প্রথম এবং প্রধানতম কাজ রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা। এ জন্য নির্বাচকমণ্ডলী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধানও নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হন। এছাড়াও স্থানীয় পরিষদগুলোর সদস্যবৃন্দও নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হন।
২. সরকারি কাজের ওপর দৃষ্টি :
নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের কাজের প্রতি কড়া নজর রাখে। নির্বাচিত প্রতিনিধি বা দেশের সরকার শাসন পরিচালনায় সীমালংঘন করলে নির্বাচকমণ্ডলী তাদের ক্ষতার অপব্যবহার রোধ করে। আবার জনমত গঠনের মাধ্যমে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৩. আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ :
প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আইন প্রণয়ন ও সংশােধন করে থাকে। তবে গণভােট, গণউদ্যোগ, পদ্চ্যুতি
ইত্যাদিতে নির্বাচকমণ্ডলী প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে যেমন সুইজারল্যান্ডে গণভােট, গণউদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতিতে নির্বাচকমণ্ডলী সরাসরি অংশ নিতে পারে।
আরও পড়ুন >> বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় আলােচনা কর
৪. জনমতের মাধ্যম :
নির্বাচকমণ্ডলী জনমত গঠনের প্রধান মাধ্যম। বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে নির্বাচকমণ্ডলীর অভিমত, নীরবতা ও সােচ্চার কণ্ঠ জনমতকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এবং সে প্রভাব দেশর সরকার ও সমগ্র শাসনকে নাড়া দেয়।
৫. সংবিধান সংশােধন :
কোনাে রাষ্ট্রই নির্বাচকমণ্ডলীর রায় না জেনে সরকার শাসনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করতে পার না তাই বলা যায়, পরােক্ষভাবে হলেও নির্বাচকমণ্ডলী শাসনতন্ত্রের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৬. রাজনৈতিক দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ :
বর্তমান যুগে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য জন্মলাভ
করেছে রাজনৈতিক দল । রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে স্বীকার না করে গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এই রাজনৈতিক সঠিক পথে পরিচালনা ও নিয়ান্ত্র করতে পারে নির্বাচকমণ্ডলী। কারণ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলসমৃহকে নির্বাচকমণ্ডলীর দরবারে হাজির হতেই হয়। মূলত বলা যায়, নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের কাজের ওপর তীক্ষ
দৃষ্টি রাখে। সরকার যেন স্বৈরাচারী না হয় সেদিকে নজর রাখতে হয় নির্বাচকমণ্ডলীকে। সরকারের স্বৈরাচারিতাকে রােধ করতে পারে একমাত্র নির্বাচকমণ্ডলী। এ জন্য দেখা যায় যে, দেশের নির্বাচকমণ্ডলী যত শিক্ষিত এবং অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন সে দেশের সরকার ততটা স্বাচ্ছন্দে শাসনকার্য পরিচালনা করে। তাই নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকার কোনােদিনই এড়িয়ে বা পাশ কাটিয় চলতে পারে না।
উপসংহার
উপরে বর্ণিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আজকের যুগে নির্বাচকমণ্ডলী রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হয়েছে। মূলত আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রণয়ন করাই- হচ্ছে নির্বাচকমণ্ডলীর প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী নিষ্ক্রিয় নয় বরং সক্রিয় হিসেবে দলের স্বেচ্ছাচারী মনােভাবকে দূর করে। তাই রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালনা ও উন্নতির পথে অগ্রসর করতে নির্বাচকমণ্ডলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।