প্রশ্ন : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় আলােচনা কর। অথবা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কী বুঝ? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ আলােচনা কর।
ভূমিকা
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যমে জনগণকে শাসন বিভাগের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা করা যায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্রের সুষ্ঠু প্রয়ােগ কল্পনাও করা যায় না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণের উপায় সম্পর্কে লর্ড ব্রাইস বলেছেন,
কোনাে দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যােগ্যতা।
নানাবিধ উপায়ে বিচার বিভাগের এই স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, বিচার বিভাগ যদি অন্য কোনাে বিভাগের প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে তাহলে তাকে স্বাধীন বিচার বিভাগ বলা যায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
অধ্যাপক গার্নার এর মতে,
If the judges wisdom, probity and freedom of decision. The high purpose for which the judiciary is established can not be secured.
লর্ড ব্রাইস এর মতে,
কোনো দেশের সরকারের কর্তৃত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে তার বিচার বিভাগের দক্ষতা যোগ্যতা।
কেন্ট এর ভাষায়,
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বিচার বিভাগের প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষতাকে বুঝায়।
হ্যামিল্টন বলেন,
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হলো অপরাপর বিভাগের হস্তক্ষেপ মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপক্ষভাবে বিচারের রায় ঘােষণা করা।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়
নিম্নে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় আলোচনা করা হলো :
১. শাসন বিভাগের স্বৈরাচারিতা রােধ :
রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করার ফলে অনেক সময় স্বৈরাচারী হয় ওঠে আর শাসন বিভাগ যদি স্বৈরাচারী হয় তাহলে রাস্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই শাসন বিভাগের স্বৈরাচারিতা রােধ করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। তাই অধ্যাপক লাস্কি মন্তব্য করেছেন,
The independence of the judiciary is essential to freedom. In that sense the doctrine of separation of powers enshrines permanent truth.
২. স্থায়িত্ব :
বিচারকদের কার্যকলাপের স্থায়িত্বের ওপরও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিশেষভাবে। নির্ভরশীল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারকরা অক্ষম হয়ে না পড়লে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত পদে বহাল থাকেন। হ্যামিলটন (Hamilton)-এর মতে,
বিচারকগণের পদের স্থায়িত্ব শাসনব্যবস্থায় উৎকর্ষের অন্যতম পরিচায়ক। বিচারকদের পদচ্যতি করার ক্ষমতা কোনাে অবস্থাতেই শাসন বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা উচিত নয়।
৩. নিরপেক্ষতা :
বিচারপতিদের কাজের সমালোচনার ওপর বাধানিষেধ আরােপ করা দরকার। বিচারপতিদের নিরপক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে নির্ভিকভাবে দ্বায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।
৪. বিচারকদের পদচ্যুতি :
বিচারকদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের বিচার সাধারণত আইসভায় সম্পাদিত করা যায় না। এ ব্যাপারে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যেমন– মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে অভিশংসন পদ্ধতিতে বিচারকের পদচ্যুত করা যায়। মার্কিন কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধি সভা অভযোগ উথাপন করে এবং সিনেট অভিযোেগের বিচার করে। ব্রিটেনে রাজা বা রানি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যৌথ আবেদনের ভিত্তিতে বিচারককে পদচ্যুত করতে পারে।
৫. উপযুক্ত বিচারপতি নিয়োগ :
সুষ্ঠভাবে বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত বিচারপতি একান্তভাবে দরকার । অযােগ্য ব্যক্তি রাজনৈতিক কারণে বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হলে ন্যায়বিচার পদদলিত রাজনৈতিক পদে নিযুক্ত করা অনুচিত। সৎ, সাহসী ও যথার্থ আইনজ্ঞ ব্যক্তিগণ বিচারপতিদের পদে আসীন হলে ন্যায় বিচারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
৬. নিয়ােগ পদ্ধতি :
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিচারকদের নিয়ােগ পদ্ধতির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিচারপতিদের সাধারণ তিনটি পদ্ধতিতে নিয়ােগ করা যায়-
- ক. জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচন
- আইনসভা কর্তৃক মনােয়ন
- শাসন বিভাগ কর্তৃক নিয়ােগ।
আইনসভার দ্বারাও বিচারপতি নিয়ােগ করা যায়। বর্তমানে প্রধান নির্বাহী কর্তৃক বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে। যোগ্যতম বিচারক নিয়োগের এটাই উত্তম পন্থা।
৭. পদোন্নতি :
যথাসময়ের পদোন্নতি না পেয়ে মানুষ হতাশার শিকার হয় এবং দায়িত্ব বিচারকদের বেলায়ও এটি প্রযােজ্য। সাধারণত জ্যেষ্ঠনীতির ভিত্তিতে পদোন্নতি হওয়া বাঞ্চনীয়। তবে বিশেষ কোনাে ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা এবং মেধাও পদোন্নতির ভিত্তি হতে পারে।
৮. বেতন কাঠামাে :
সল্প বেতনভােগী বিচারকদের দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শ্রেষ্ঠ যােগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তকে বিচারক পদে আকৃষ্ট করার জন্য বিচারকের বেতন ও ভাতা পর্যাপ্ত হওয়া প্রয়ােজন। বিশেষ জবুরি অবস্থা ব্যতীত বিচারকদের সার্থ ক্ষুণ করে তাদের বেতন, ভাতা ও সুযোেগ সুবিধার পরিবর্তন করা উচিত নয়।
৯. সামাজিক অবস্থান :
বিচারক নিয়োগের পূর্বে তার পারিবারিক অবস্থান, মর্যাদা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা প্রভৃতি বিষয়েও অবগত হওয়া প্রয়ােজন।
সামাজিক অবস্থাজনিত কারনের জন্য বিচারপতিদের মূল্যবোধ, মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়ে থাকে। তাই সামাজিক ঘটনা, প্রভাব ও চাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে কাজ করা বিচারকের পক্ষে সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন >> আধুনিক শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ গুলো আলােচনা কর
১০. বিচারকদের ওকালতি বন্ধকরণ :
অবসর গ্রহণের পর আদালতে ওকালতি করলে বা কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করলে বিচার বিভাগের রায় ও সিদ্থান্তকে প্রভাবিত করার জন্য পূর্বতন পরিচয় ও প্রভাবকে প্রয়োগ করতে পারেন। বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের অধীনে তাদের ওকালতি নিষিদ্ধ করা উচিত।
১১. নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ :
সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিচার বিভাগ নাগরিকদের উপযুক্ত অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করতে গিয়ে কয়েকটি বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে। এ পদ্ধতিসমূহ হলাে
- হেবিয়াস কর্পাস (Habeas corpus),
- ম্যানডেমাস (Mandamus),
- সারটিওয়ারি (Cetiorari)
- কোয়ারেন্টো (Quowarranto)।
হেনরি সিজউইক (Henry Sidgwick) এর মতে,
বিচার বিভাগ হলো সেই বিভাগ, যা আইনের ব্যাখ্যা করে এবং আইনের প্রয়োেগ করে।
১২. বিচারকদের নিরাপত্তা :
আলফ্রেড ডেনিং (AIfred Denming) এর মতে,
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো।বিচার বিভাগ, যা জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে সে উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার রিট জারি করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেক সময় বিচারকগণ সঠিক সিদ্বান্ত নিতে পারে না। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে।
১৩. লিখিত সংবিধান :
অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garnner) এর মতে,
বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে সভ্য রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না।
সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন, যার মাধ্যমে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। যদি বিচারকরা লিখিত সংবিধানের ধারা অনুযায়ী রায় দেয় তাহলে জনগণের মধ্যে রায় সম্পর্কে ভুল বাঝাবুঝি থাকবে না। তাই লিখিত সংবিধান বিচার বিভাগের স্বধীনতা রক্ষা করে।
১৪. বিচারক নির্বাচন পদ্ধতি :
জনগণের দ্বারা বিচারক নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে বিচারকগণ জনসমর্থন লাভের আশায় সতত জনসাধারণের সন্তুষ্টি বিধানে আত্মনিয়ােগ করবেন। বিচারপতি পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাছাই করার জন্য প্রয়ােজনীয় বিচারবুদ্ধি বা যােগ্যতা জনসাধারণের থাকে না। এই কারণে জনগণের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়ােগ পদ্ধতি অধ্যাপক লাষ্কি (LaSki) এর মতানুসারে একটি নিকৃষ্ট পদ্ধতি।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোেচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে. বিচার বিভাগ আইনকে যেভাবে ব্যাখ্যা করবে, আইন সেভাবেই পরিচালিত হবে এবং প্রয়ােগ করা হবে। আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিচারপতিগণের বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। যাতে আইনের অপব্যবহার রােধ করে সুষ্ঠু প্রয়ােগ করা যায়। তবে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ হওয়ায় এক রাজনৈতিক প্রভাব থেকে যুক্ত করে এর সুষ্ঠু প্রয়ােগ ঘটানাে সম্ভব নয়। তাই অধ্যাপক লাস্কি বলেন,
বিচার ব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিরপেক্ষ হতে পারে না।