রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রয়ােজনীয়তা আলােচনা কর

প্রশ্ন : রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রয়ােজনীয়তা
আলােচনা কর। অথবা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের গুরুত্ব আলাচনা কর।

ভূমিকা :

সংবিধান একটি রাষ্ট্র পরিচালনার পথপ্রদর্শক। সংবিধানে রাস্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ব্ণিত থাকে। সংবিধান সরকার ও জনগণের মাঝে সরকারকে স্বৈরাচারী ভূমিকা থেকে প্রতিহত করে জনগণের কল্যাণে শাসন পরিচালনার দিকে মনােনিবেশ ঘটায়। সংবিধান শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্রের পরিচালনায় মূলনীতি নয় এবং সংবিধানের মাধ্যমে শাসক ও শাসিতর সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।

রাস্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রয়ােজনীয়তা :

সংবিধানে রাস্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বর্ণিত থাকে। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সংবিধাन দ্বারা স্বীকৃত হয়। ফলে রাষ্ট্রে কোনো বিভাগ একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। নিম্নে রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলাে :

ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি :

মন্টেস্কু ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি দ্বারা আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে পৃথক করার ব্যবস্থা করেন এবং ‘Checks of balance’ নীতি দ্বারা ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর সব সংবিধানে এই ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রতিষ্ঠিত যা আইনের প্রাধান্য ও সুশাসন নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জনকল্যাণ :

জনকল্যাণই যে সরকারের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা সংবিধান এ বর্ণিত থাকে। ফলে সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ ও জনগণের চাহিদা পূরণ।

এ প্রসঙ্গে C. F. Strong লিখেছেন, “Constitution according to which the powers of the government the rights of governed and the relation between the two are adjusted.” অর্থাৎ, সংবিধান হচ্ছে সেইসব নিয়মকানুনের সমষ্টি যা দ্বারা সরকারের ক্ষমতা শাসিতের অধিকার এবং এ দুয়ের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে থাকে।

সংবিধানের প্রাধান্য :

সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ আইন। বিচার বিভাগ সংবিধানের ব্যাখ্যাদাতা ও রক্ষক। সংবিধান লঙ্ঘিত হলে বিচার বিভাগ তা প্রতিহত করে। সংবিধান বিরোধী কোনাে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকলে সরকার অবৈধ হয়ে পড়ে। কিন্তু সংবিধান তা প্রতিহত করে। সুতরাং গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনতন্ত্র প্রাধান্য সরবরত্র স্বীকৃত।

পররাস্ট্রনীতি গ্রহণ :

সংবিধানে পররাষ্ট্রনীতি সন্নিবেশিত থাকে। যেমন বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত আছে ,“Friendship to all, mnalice to none.” অর্থাৎ বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়। পররাস্ট্রনীতি সাধারণত সেই দেশে আর্থসামাজিক প্রক্ষাপটে রচিত হয়। এর ফলে গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি সেই দেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো প্রতিফলিত করে।

মৌলিক অধিকার সুরক্ষা :

মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় অপরিহার্য। সংবিধানের নির্দিষ্ট ধারায় মৌলিক অধিকারের বর্ণনা দেওয়া থাকে। মৌলিক অধিকার মৌলিক অধিকার আরও বিস্তৃত পরিসরে থাকে। কেননা জনগণের কল্যাণই আধুনিক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য।

আরও পড়ুন >> সংবিধান এর উৎসসমূহ সংক্ষেপে আলােচনা কর

গণতন্ত্রের বিকাশ :

গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার জন্য সংবিধানের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। সংবিধান একটি সরকারের মেয়াদকে নির্দিন্ট সময়ের মাঝে আবদ্ধ করে। মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সর্বজনীন ভােটের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে সরকার জনবিরোধী হয়ে পড়ে। ভােটের সংস্কৃতি বজায় রাখার মাধ্যমে গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ শন্তিশালী হয়, যা গণত্ত্ বিকাশে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। 

জাতীয়তাবাদের বিকাশ :

সংবিধানের মূলনীতিগুলো আসে একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে। যা একটি দেশের স্বকীয়তাকে ফুটিয়ে তােলে। জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভূমিকা পালন করে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠা :

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়েভেলির মতে, “মানুষ লোভী স্বার্থপর ও হিংসুক। যার জন্য রা্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।” এই বিশৃঙ্খলা দমন ও আইনের শসন প্রতিষ্ঠায় সংবিধানের ভূমিকা অপরিহার্য।

জনগণের আশা আকাঙ্ফার প্রতিফলন :

জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন সংবিধানে ঘটে। সংবিধান রচিত হয় একটি দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে। যাতে জনগণের দাবির প্রতিফলন ঘটে। সংবিধান রাষ্ট্রীয় জীবনের মূল চাবিকাঠি ।

জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষাদান :

একটি দেশের সংবিধান জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষা দান করে। জনগণকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করে।

দেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরন :

এ বিষয়ে লুইস (Lewis) বলেন, “Constitution signifies the arrangement and distribution of the sovereign power is the community of form of government ” অর্থাৎ সংবিধান কোনো সমাজে সার্বভৌম ক্ষমতার বিন্যাস ও বন্টন বা সরকারের রৃূপ নির্দেশ করে সংবিধান দ্বারা সার্বভৌম ক্ষমতা উপস্থাপন করা হয়। যা একটি
ভূখণ্ডকে রাষ্ট্রে পরিণত করে।

সরকার পরিচালনার মূলনীতি :

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গিলক্রাইস্ট এর মতে,  “Constitution is that body of rulers of written laws or unwritten laws which determine the organization of government, the distribution of powers government and the general principles on which these powers are exercised.” অর্থাৎ লিখিত বা অখিখিত বিধিবিধান
আইনের সমষ্টি যা সরকারের সংগঠিন, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যকার ক্ষমতা বণ্টন এবং উক্ত ক্ষমতা কার্যকর করার সাধারণ নীতিমালা হচ্ছে সংবিধান। সংবিধানে সরকার পরিচালনার মূলনীতি সন্নিবেশিত থাকে। যা সরকার পরিচালনার বৃপরেখা। সংবিধান সরকারের কার্যবলি পরিচালনার গাইড লাইন হিসেবে কাজ করে।

অখন্ড শাসনব্যবস্থা :

অথন্ডতা ও সামগ্রিকতা নিরশ্চিত করা হয় সংবিধানের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে লর্ড ব্রাইস বলেন, “Constitution is the aggregate of laws and customs
under which the life of the state goes on, or the complex totally of laws on bodying the principles
and rules whereby the community is organized,
governed and held together.” অর্থাৎ সংবিধান হলো এমন কতগুলাে আইন ও প্রথার সমষ্টি যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত হয়। অথবা, এমন কতিপয় আইনের সমন্বয় ঘটে যাতে সম্প্রদায়কে সংগঠিতভাবে শাসন এবং একত্রীকরণের নীতিমালা এবং নিয়মা্বলি সংযোজিত হয়েছে।

জাতীয় ঐতিহ্য :

জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় সংবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। সংবিধান সেদেশের ঐতিহ্যের ধারক বা বাহক।
সংবিধান দ্বারা একটি জাতির স্বকীয়তা ও মর্যাদা প্রস্ফুটিত হয়।

রাজনৈতিক সংস্কার :

সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় রাজনৈতিক সংস্কারের বিভিন্ন পদ্ধতি বর্ণিত থাকে। ফলে রাজনৈতিক সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে অনিশ্চয়তা দূর হয়।

উপসংহার :

উপর্যুনক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিত বলা যায় যে,
সংবিধান ছাড়া আধুনিক জাতি রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না।
সংবিধান রাষ্ট্রের শাসন যন্ত্রকে সচল রাখে। সংবিধান  সরকার ও জনগণের মাঝে সেতুবন্ধন। তাই সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। অতএব একটি সর্বসম্মত মৌলিক নীতিমালা তথা সংবিধান প্রণয়নের বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন >> সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ বর্ণনা কর

শেয়ার করুন :

Leave a Comment