প্রশ্ন : বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনা কর। অথবা, শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি বর্ণনা কর।
ভূমিকা
সরকারের শাসন বিভাগই হলো সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। বর্তমান জনকল্যাণমূলক কাজে শাসন বিভাগ বহুবিধ কার্য সম্পাদন করে। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাও শাসন বিভাগের দ্বারা প্রযুক্ত হয়। এছাড়াও আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইনসমূহকে সরকার শাসন বিভাগের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত করে থাকে। মােটকথা, শাসন বিভাগের দক্ষতার ওপর রাষ্ট্রের উন্নতি ও অবনতি অনেকাংশে নির্ভর করে।
বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনবিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
শাসনবিভাগ আইনবিভাগের প্রণীত আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে থাকে। আধুনিক যুগে রাষ্রয় প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই শাসন বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নিম্নে বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনবিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনা করা হলাে :
১. শাসনসংক্রান্ত :
শাসন বিভাগ শাসনসংক্রান্ত নানাবিধ কার্যসম্পাদন করে থাকে। সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও আমলাদের পরিচালনা, নিয়ােগ প্রভৃতি কাজ শাসন বিভাগ করে থাকে। রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য নানাবিধ উন্নয়ন পরিকল্পনা, শিল্প ও কৃষি উন্নয়ন প্রভৃতি কাজ শাসন বিভাগ করে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারের তিন বিভাগের মধ্যে শাসন বিভাগের গুরুত্ব সর্বাধিক। শাসন বিভাগ সবচেয়ে বেশি জনগণের নিকটে পৌছাতে পারে।
২. জনকল্যাণ :
শাসন বিভাগ জনকল্যাণ নিশ্চিত কল্পে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। বলা যায়, জনকল্যাণ সাধনই শাসন বিভাগের লক্ষ্য। আইন বিভাগে প্রণীত আইন শাসন বিভাগ বাস্তবায়ন করে থাকে। রাস্ট্রের উন্নয়নে অবকাঠামাে, চিকিৎসা, শিক্ষার প্রসারে শাসন বিভাগ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।
৩. নাগরিক অধিকার নিশ্চিত :
সংবিধান কর্তৃক প্রযুক্ত মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে শাসন বিভাগ নিয়ােজিত থাকে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি বাস্তবায়নে শাসন বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তরকে নিয়োেজিত করে। নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিকের বিকাশের সুযোগ প্রধান করা হয়। যা একটি কল্যণকামী রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য ।
৪. জননিরাপত্তা :
শাসন বিভাগ জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করা। শাসন বিভাগ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শাসন বিভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে জন নিরাপত্তামূলক আইন বাস্তবায়ন করে। নিশ্চিতকরণ শাসন বিভাগ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তােলে। শাসন বিভাগ দেশের নিরাপত্তার
জন্য নানাবিধ বৈদেশিক দ্বিপাক্ষীয়, বহুপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করে। যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অংশ নেয়। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মূলত শাসন বিভাগের ওপরই ন্যস্ত থাকে।
৬. দেশের মুখপাত্র :
শাসন বিভাগ দেশের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। বহির্বিশ্বে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে এই শাসন বিভাগ। শাসন বিভাগ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন জাতিসংঘ। নানা আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান যেমন সার্ক, আসিয়ান প্রভৃতি সংগঠনে দেশে প্রতিনিধিত্ব করে এবং নিজ দেশের প্রয়াজনীয়তা উথাপন করে।
৭. অর্থনৈতিক কার্যাবলি :
শাসন বিভাগ নানা অর্থনৈতিক কার্যাবলি সম্পাদন করে। আইন বিভাগ থেকে মঞ্জুরকৃত বাজেট শাসন বিভাগ বাস্তবায়ন করে থাকে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসক প্রধানকে বাৎসরিক আয় ব্যয়ের রিপোর্ট আইনসভায় পাঠাতে হয়। কর ধার্য ও ব্যয় বরাদ্দের ব্যাপারে আইনসভার অনুমােদন আবশ্যক।
৮. কুটনৈতিক কার্যাবলি :
কুটনীতিকদের প্রেরণ, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বিচারে কোনো দেশের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি, বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদন, কোনাে দেশের সাথে সমস্যা নিরসনে কুটেনৈতিক প্রচেষ্টা এসবই শাসন বিভাগ করে থাকে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তবে এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টকে সিনেটের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়।
৯. আইনপ্রণয়ন সংক্রান্ত :
শাসন বিভাগ সংসদ আহ্বান, স্থগিত করতে পারে। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদসংখ্যা গরিষ্ঠ দলের সদস্য। যারা আইন প্রণয়নেও শাসন বিভাগ অনেক খসড়া আইনই আটকে দিতে পারে। আবার নিজেদের শাসন উপযােগী আইন প্রণয়নে দলকে দিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে।
আরও পড়ুন >> আইনসভার গঠন আলোচনা কর
১০. জাতীয় ঐক্য সাধন :
শাসন বিভাগ জাতীয় ঐক্য সাধনে ভূমিকা রাখে। প্রধানমন্ত্র অথবা রাষ্ট্রিপতিকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তিনি বিদেশে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। রাষ্ট্রপতি একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। জাতির সংকটকালে নির্বাহী বিভাগই জাতিকে সামনে থেকে দিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে।
১১. গণতান্ত্রিক উন্নয়ন :
শাসন বিভাগ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সামনে থেকে নেতৃত্বদান করে গণতান্ত্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। দেশের রাজনৈতিক সংকট দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত করে। শাসন বিভাগের অস্তিত্ব এতে হুমকির সম্মুখীন হয়। আর তাই দেশের গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার জন্য শাসন বিভাগকে নেতৃত্ব প্রদান করতে হয়।
১২. সামাজিক দায়বদ্ধতা :
সরকারের অন্য তিন বিভাগের মধ্যে শাসন বিভাগে সামাজিক দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বেশি। কেননা মুখ্য রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের অধিকাংশই শাসন বিভাগের অধীনস্থ। শাসন বিভাগের নির্দেশেই এ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। শাসন বিভাগের
রাজনৈতিক ভিত্তি রয়েছে সমাজ ব্যবস্থায়। শাসন বিভাগের সদস্যগণ জনগণের সরাসরি ভােটে নির্বাচিত হন। ফলে শাসন বিভাগ সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ থাকে।
১৩. দলব্যবস্থার উন্নয়ন :
দলব্যবম্থার প্রসার, সাংগঠনিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, দলীয় নির্দেশ প্রভৃতি শাসন বিভাগ করে থাকে। সংসদীয় সরকারে এ প্রক্রিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত। এখানে নিরঙকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। মন্রিসভার সদস্যগণই শাসক দলের উর্ধতন নেতা। তারা আইন প্রণয়নে নেতৃত্ব দেন। কাজেই তাদের নির্দেশ অমান্য করে সংসদে দলীয় প্রস্তাবের বিরোধিতা করা মানেই ভবিষ্যৎ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযাগ নষ্ট করা। ফলে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনসভা প্রকৃতপক্ষে শাসন বিভাগীয় নির্দেশ অনুমােদনের সংম্থায় পরিণত হয়েছে।
১৪. সংখ্যালঘুদের স্বার্থসংরক্ষণ :
শাসন বিভাগ সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে থাকে। কারণ সংবিধানেই বিভিন্ন উপায়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। শাসন বিভাগ সেসব সাংবিধানিক বিধানসমূহ বাস্তবায়ন করে থাকে। সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে।
১৫. সংবিধান সংশােধন :
শাসন বিভাগ সংবিধান সংশােধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। শাসন বিভাগের সদস্যরা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্য হয়ে থাকেন। শাসন বিভাগের সদস্যদের পরামর্শক্রমে আইন বিভাগ সংবিধান সংশােধনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সংসদ সদস্যরা দলীয় সিচ্ধান্তের বাইরে কোনাে সিদ্ধান্ত নিলে তাদের দলীয় সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। তাই শাসন বিভাগ নিজের ক্ষমতা বলে আইন বিভাগের সদস্যদের দ্বারা সংবিধান সংশােধনের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমানে শাসন বিভাগের কার্যাবলি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে শাসন বিভাগ এখন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। তবে আইনসভার পরিবর্তে শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি।একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় অনেক সময় স্বৈরাচারীর ভূমিকা পালন করে। তারপরও আবার রাষ্ট্রপতি বলা যায় রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে অস্বীকার করা যায় না।