প্রশ্ন : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সুবিধাসমূহ আলোচনা কর। বাংলাদেশে এর প্রয়ােগ উল্লেখ কর। অথবা, Discuss the advantages of decentralization policy অথবা, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপযোগিতাসমূহ বর্ণনা কর।
ভূমিকা
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল বক্তব্য হলাে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা এক ব্যক্তি বা কতিপয়ের হাতে না থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে অর্পিত থাকা। কোনাে ব্যক্তিই সকল ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে না। বিধানানুসারে রাষ্ট্রের তিনটি আজ্ঞা বা বিভাগ রয়েছে। যখন এ তিন বিভাগের কাজ একক ব্যক্তি বা দলের দ্বারা না হয়ে বিভিন্ন সংস্থা বা ব্যক্তিবর্গের দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তাকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলে।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সুবিধাসমূহ
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি বহু সমালােচিত হলেও এর কিছু সুবিধা রয়েছে। যার ওপর ভিত্তি করে কিছু দেশে এর প্রয়োগ ঘটেছে। নিম্নে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সুবিধাসমূহ আলােচনা করা হলাে :
১. বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি করে :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমে সরকারের প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের কাজে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। সুতরাং ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন।
২.গণতন্ত্র রক্ষায় সহায়ক :
গণতন্ত্র রক্ষায় এই নীতির প্রয়োগ বিভাগের ব্যক্তিগণ ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে কোনাে বিরাধ সংঘটিত হলে বিচার বিভাগ এক্ষত্রে শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে সঠিক রায় প্রদান করে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখুতে পারে।
৩. সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অন্যতম প্রধান গুণ হলো এ নীতি প্রয়ােগের ফলে সরকারের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কেননা প্রতিটি বিভাগই অন্যান্য বিভাগের এখতিয়ার মুক্ত থেকে নিজেকে পৃথক রেখে তার ওপর অপিত দায়িত্ব পালন যথাযথভাবে এবং ঝামেলামুক্তভাবে সম্পাদন করতে পারে। এর ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় ক্ষমতা স্বতন্রীকরণ নীতি প্রয়োগের ফলে প্রতিটি বিভাগ একটি কাজে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
৪. জরুরি অবস্থায় সহায়ক :
জরুরি অবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ সফল হতে পারে। কেননা এখানে শাসন বিভাগ আইনসভার অযথা নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে দ্রুত প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
৫. স্বৈরাচারিতা রােধ :
স্বৈরাচারিতা রােধে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বেশ কার্যকর। কেননা সরকারের সব ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে থাকলে সে ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী শাসকে পরিণত হতে পারে। তাই সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করলে সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না। সুতরাং ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ সরকারের স্বৈরাচরিতা রােধ করে।
৬. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলাে এটি ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করে। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। আর ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের মাধ্যমেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। অতএব বলা যায়, ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা হয়।
৭. বৈজ্ঞানিক নীতি ব্যবহার :
বৈজ্ঞানিক উপায়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ব্যবহার খুবই অপরিহার্য। কর্মের শ্রেণিকরণ নীতি হচ্ছে আধুনিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম মৌলিক নীতি। কেননা তার অনুশীলনকে যথাযথভাবে নিশ্চিতকরণার্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােজনীয়তা আবশ্যক।
৮. নিয়ন্ত্রমুক্ত বিভাগ :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অন্যতম উপযােগিতা হলাে এর এক বিভাগ অন্য বিভাগের প্রভাবমুক্ত। ফলে প্রত্যেকটি বিভাগ স্বাধীনভাবে কার্যসম্পাদনে সচেষ্ট থাকে। এই নীতির প্রয়ােগ ঘটলে দেশে দ্রত উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে। কেননা একটি বিভাগ স্বীয় স্বার্থে অন্য বিভাগের উন্নয়নে বাধা প্রদান করতে পারে।
৯. মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ :
বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতামূলক ভূমিকার মাধ্যমে শাসন বিভাগের অন্যায় অযৌক্তিক নীতিকে বাধা প্রদানের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হতে পারে।
আরও পড়ুন >> ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর
বাংলাদেশে ক্ষমতা স্বতনীকরণ নীতির প্রয়োগ
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাংলাদেশের সংবিধানে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। সংবিধানে সরকারের শাসন বিভাগ শাসনকার্য পরিচলনা করবে। আইন বিভাগ আইন তৈরি করবে এবং বিচার বিভাগ বিচারকার্য পরিচালনা করবে। ফলে স্বতন্ত্র তিনটি বিভাগের উল্লেখ থাকলেও পার্লামেন্ট বা আইনসভার সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। এখানে শাসন বিভাগ আইনসভার নিকট সরাসরি তাদের কাজকর্মের জন্য দায়ী। তাছাড়া সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত থাকায় শাসন বিভাগ ও আইনসভা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্যুক্ত এবং পরস্পরের দ্বারা প্রভাবান্বিত। শাসন বিভাগ আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে শাসন বিভাগ ক্ষমতা হারায়। অন্যদিকে, আইনসভা প্রণীত প্রতিটি আইনই বৈধ। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইনকে বাতিল ঘােষণা সংবিধানবিরােধী বা অবৈধ বলে ঘােষণা করতে পারে মাত্র। তাছাড়া বিচার বিভাগের বিচারকদের নিয়াোেগ চুড়ান্তভাবে শাসন বিভাগের হাতে ন্যস্ত এবং অপসারণের বিষয়টি আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট। ফলে তত্বগত ও বাস্তবক্ষেত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ বাংলাদেশে লক্ষ করা যায় না। তবে বিচারকরা একবার নিয়ােগপ্রাপ্ত হলে তাদের বিচারবু্ধি ও বিবেক দ্বারা সর্বপ্রকার ভয়ভীতি ও হস্তক্ষেপের ঊর্ধ্বে থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় আইনের ব্যাখ্যা ও বিচারের রায় প্রদান করে থাকেন। বাংলাদেশে তাই সরকোরের ক্ষমতার কার্যগত স্বতন্ত্রীকরণ এর বিপরীতে কাঠামােগত স্বতন্ত্রীকরণ বিদ্যমান।
উপসংহার
উপরোক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই বিদ্যমান তবে এ নীতির আসল যৌক্তিকতা হলাে জনগণের স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার সংরক্ষণ। যখন আইন ও শাসন বিভাগের ক্ষমতা একজন ব্যক্তি বা একদল শাসকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তখন জনগণের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা আইন পরিষদ বা শাসন বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র না হলে স্বাধীনতা বজায় থাকে না।