প্রশ্ন : আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারন সমূহ আলোচনা কর। অথবা, আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারন এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে আলােচনা কর।
ভূমিকা
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইনসভা রাস্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইনসভা অন্যতম। কিন্তু বিংশ শতকে রাজনৈতিক আলোচনায় শাসন বিভাগের প্রাধান্যের অপ্রতিহত অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় এবং আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পায়। বর্তমানে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারন এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি রাজনৈতিক আলােচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারন এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ সমূহ
যেসব কারণে আইনসভার ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে সেগুলাে নিম্নে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারন আলোচনা করা হলাে :
১. জনকল্যাণমূলক কাজ বৃদ্ধি :
রাষ্ট্রটির জনকন্যাণমূলক কাজ বেড়ে গিয়েছে। জনগণ এখন আইনসভা অপেক্ষা শাসন বিভাগের দিকে বেশি তাকিয়ে থাকে। যােগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিগণ এখন আইন বিভাগ অপক্ষা শাসন বিভাগের দায়িত্ব পালনে অধিক আগ্রহী। ফলে আইন বিভাগের প্রাধান্যের পরিবর্তে শাসন বিভাগের প্রধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. আইনসভার গুণগতমান :
জাতীয় জীবনের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভা কার্যত শাসন বিভাগের এ প্রাধান্যমূলক কার্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। জ্ঞানী গুণি ব্যন্তি নির্বাচনে যেতে চায় না সে কারণে সংসদে সাধারণ ব্যক্তির সমাগম ঘটে। ফলে জনগণের আস্থা আইনসভার গুণগত মান থাকে না। ফলে
স্বাভাবিকভাবেই তা আইন বিভাগের প্রাধান্যের পরিবর্তে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. অর্থনীতিসংক্রান্ত :
রাষ্ট্রের বহুবিধ অর্থনৈতিক সংকট ও সমস্যা মােকাবিলায় শাসন বিভাগই গুরু দায়িত্ব পালন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি রুজভেন্ট “নিউ ডিল’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সর্বোপরি জাতীয় সংকট ও জরুরি অবস্থায় আইনসভা প্রয়ােজনমতাে দ্রুত ও দূঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়।
৪. আইন প্রণয়নের জটিলতা :
আইন প্রণয়নের জটিলতা বৃদ্ধি আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ আইনের খুঁটিনাটি সুক্ষ বিষয় ও জটিলতা সম্পর্কে আইনসভা অধিকাংশ সমস্যা ঠিকভাবে আনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু শাসন বিভাগ এ সমস্যা ঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম। ফলে শাসন বিভাগের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।
৫. সরকার ও জনগনের সংযোগ :
সরকার ও জনগনের মধ্যে সংযােগ সাধনের মাধ্যম হিসেবে আইনসভার ভূমিকা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং শাসন বিভাগের ভূমিকা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সময়ে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী ও সংগঠন জনগণের স্বার্থ ও সমস্যাবলি সম্পর্কে সরকারের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলে একে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারন হিসবে গণ্য করা হয়।
৬. আইনের বিবর্তন :
আইন প্রণয়নের জটিলতা বৃদ্ধি আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ। বর্তমানে আইনের চরিত্র অনেকাংশেই পাল্টে গেছে। এসব কার্যাবলি সুষ্ঠূভাবে সম্পাদন করার জন্য শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। আর শাসন বিভাগ এ নেতৃত্বদানে দক্ষ। তাই শাসন বিভাগের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৭. সমালােচনায় অক্ষমতা :
শাসন বিভাগের কাজকর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য আইনসভার হাতে নেই। তাই আইনসভা কার্যকরভাবে শাসন বিভাগের -সমালোেচনা করতে পারছে না। ফলে শাসন বিভাগের সাথে জনগণের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পায়।
৮. সংসদীয় ব্যবস্থা ব্যর্থ :
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশে প্রবর্তিত সংসদীয় ব্যবম্থা ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দূর্বলতা, দলীয় কোন্দল, রাজনৈতিক দলের অক্ষমতা প্রভৃতি কারণে সংসদায় সরকারের ব্যর্থতা সৃচিত হয়। এ প্রসঙ্গে র্যামজে ম্যূর (Ramsay Muir) এর অভিমত হলোে যে, “শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ক্যাবিনেটে নায়কতন্তের সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন >> বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনা কর
৯. শাসন বিভাগের দায়িত্ব প্রতিস্থাপন :
আইন প্রণয়ন, প্রশাসন পরিচালনা, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, বিভিন্ন আর্থসামাজিক বিষয় সর্বক্ষেত্রেই শাসন বিভাগকেই দায়িত পালন করতে হয়। আইনসভার পরিষদের সদস্যদের তুলনায় শাসন বিভাগের সদস্যরা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। ফলে শাসন বিভাগের প্রতি জনগণ অধিক আস্থাশীল হয় ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
১০. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন :
বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উন্নতির ফলে আইনসভা পূর্বের মতাে ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়ে শাসন বিভাগকে নানাবিধ কার্য সম্পাদন করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হচ্ছে। এ কারণে আইনসভার মর্যাদা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।
১১. শাসন বিভাগের সার্বভৌমত্ব :
আধুনিক সরকারের জটিল সমস্যার সমাধান ও অন্যান্য দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় শাসন বিভাগ অধিকতর যােগ্য নেতৃত্ব প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে। আইন সভার সদস্যদের তুলনায় শাসন বিভাগ অধিক অভিজাতসম্পন্ন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এর সক্ষম নেতৃত্বে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
১২. অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা :
শাসন বিভাগের হাতে অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা ও জরুরি অবস্থা ঘাষণার ক্ষমতা থাকায় আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পায় হওয়ার পূর্বেও শাসন বিভাগ আইন সভাকে ভেঙে দেয়। শাসন বিভাগ অনেক সময় তাদের সৈরাচারী ক্ষমতা বহাল রাখার জন্য সাংবিধানিক ক্ষমতা স্থগিত রেখে আইনসভার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরােপ করে। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
১৩. জাতীয় সংকট :
জাতীয় সংকট মােকাবিলা ও জরুরি প্রয়ােজনে আইসভা দ্রত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ সমস্ত ক্ষেত্রে আইনসভার সদস্যরা তেমন উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে না। ফলে শাসন বিভাগের ওপর জনগণের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। এটি আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারন উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
১৪. তথ্যের অপর্যাপ্ততা :
আধুনিক কালে সরকারি কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়ােজনীয় তথ্যাদি আইনসভার কাছে নেই। আইন বিভাগ প্রয়ােজনীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অভাবে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। ফলে শাসন বিভাগের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে। প্রায়ােজনীয় তথ্যাদি না থাকায় বিপুল দায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আইনসভা এই ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব পালন করতে পারে।
১৫. কূটনীতি :
কূটনীতির মারপ্যাচ ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব শাসন বিভাগকে বহন করতে হয়। সামরিক ও প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে গােপনীয়তা রক্ষা আলােচনায় তা সম্ভব হয় না। সর্বোপরি যুদ্ধ ও জাতীয় সংকটে আইনসভা প্রয়ােজনমত দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
১৬. শাসন বিভাগের গ্রহণযােগ্যতা :
জনগণ এখন আইনবিভাগ অপেক্ষা শাসন বিভাগের জনকল্যাণের জন্য সরকারকে বহুবিধ কার্য করতে হয়। যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিগণ এখন আইন বিভাগ অপেক্ষা শাসন বিভাগের দায়িত্ব পালনে অধিক আগ্রহী। এরুপ শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
১৭. শাসন বিভাগের দক্ষতা :
আইন পরিষদের সদস্যদের তুলনায় শাসন বিভাগের সদস্যরা বেশি সম্মানের অধিকারী। শাসন বিভাগ জনগণের নানাবিধ প্রয়োজনের সাথে পরিচিত হয়। ফলে শাসন বিভাগের সাথে জনগণের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। এর ফলে আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আইনসভা প্রত্যেক দেশের উন্নতিকল্পে গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। তবে বর্তমানে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাসন বিভাগের এ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস সংশ্লিষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। তবে শাসন বিভাগের ক্ষমতা যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, আইনসভার প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।