বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব

প্রশ্ন : বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব আলােচনা কর। অথবা, বাংলার সমাজ কাঠামাের ওপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব আলোচনা কর।

ভূমিকা :

আর্থসামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একটি কালাে আইন হিসেবে বিবেচিত। যদিও বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কদাচিৎ সুফল লক্ষ করা যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে তত্কালীন বাংলার কৃষি অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসের মুখে পতিত হয় এবং বাংলার অধিকাংশ মানুষ কৃষক হওয়ায় এদেশের নিন্নবৃত্তের মানুষের অর্থনৈতিক জীবন ভেঙে পড়ে।

বাংলার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব :

নিম্নে বাংলার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব আলোচনা করা হলো –

বাংলার কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস :

বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশের কৃষি অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একদিকে ইংরেজ সরকার বেশি করে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করে, অন্যদিকে জমিদাররা বেশি রাজম্ব আদায়ের জন্য দিতে না পরে অনেক কৃষক কৃষিকাজ ছাড়তে বাধ্য হয়।

কৃষকদের অর্থনৈতিক দুর্গতি :

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে এদেশের জামিদাররা চরম নির্দয় হয়ে ওঠে এবং অধিক রাজস্ব আদায়ের জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। এতে বাংলার অনেক কৃষক তাদের জমি থেকে উৎ্খাত হয়, যার ফলে এদেশের কৃষকদের জীবনে অর্থনৈতিক দুর্গতি নোমে আসে।

ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সচ্ছলতা :

চিরস্থায়ী আইনের মাধ্যমে জমিদারদের স্থায়ীভাবে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এতে ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে তত্কালীন ব্রিটিশ সরকার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বাজেট ঘোষণা করতে পারত।

জমিদারির বাণিজ্যিকীকরণ :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারি প্রথাকে এদেশে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়। এর ফলে এদেশের অনেক মানুষ জমিদারি ব্যবসাকে বাণিজ্যিকভাবে গ্রহণ করে। এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমিদারদের জন্য ইতিবাচক হলেও সাধারণ মানুষের জন্য ছিল চরমভাবে নেতিবাচক।

ব্রিটিশ সরকারের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ব্রিটিশ সরকার দীর্যমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা এতে জমিদারদেরকে চিরস্থায়ীভাবে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করে অধিক রাজস্ব আদায় করে তা।

আরও পড়ুন  >> ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলােচনা কর

শিল্পের বিকাশ ব্যাহত :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশের শিল্পের বিকাশ চরমভাবে ব্যাহত হয়। এ আইনের ফলে এদেশের বিত্তশালীরা ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পের ঝুঁকি এড়াতে জমিদারিতে বিনিয়াোগ করে। এতে করে এদেশের শিল্পের
বিকাশ চরমভাবে ব্যাহত হয়। এছাড়াও ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সময়ে সেখানকার পণ্যসামগ্রী এদেশে বিক্রি শুরু হলেও এদেশের শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হয়।

বাংলার সামাজিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব :

নিম্নে বাংলার সামাজিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব
আলােচনা করা হলো –

সামাজিক বিপর্যয় :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে এদেশের চিরস্থায়ী জমিদারি প্রথা কার্যকরী হয়। এতে ব্রটিশ সরকারের রাজস্বের পরিমাণ ঠিক থাকলেও জমিদাররা অতি মুনাফার জন্য অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতাে। এতে এদেশের কৃষক সমাজের আর্থসামাজিক জীবনে চরম হতাশা নেমে আসে, যার চূড়ান্ত
ফলাফল হলাে এদেশে সামাজিক বিপর্য়।

মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম দশ বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় অর্ধেক রাজস্ব ভূমি নতুন জমিদারদের হস্তগত হয়; যাদের সাথে জমির কোনাে সম্পর্ক ছিল না। এ নতুন জমিদাররা শহরে বসবাস করতা এবং তাদের পুরাতন ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিল। তারা তাদের নায়েব-গােমস্তা প্রভূতির নিকট জমি ইজারা দিয়ে রাজন্ব আদায় করতাে। এর ফলে বাংলায় জমিদার, তালুকদার, মহাজন প্রভত নামে বিভিন্ন মধ্যস্থত্বভােগী শ্রেণির উদ্তভব হয়।

কৃষক শ্রেণির ওপর নির্যাতন :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশের কৃষকসমাজের ওপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। নির্ধারিত রাজম্ব আদায় ছাড়াও জমিদার, নায়েব, গােমস্তা, সরকারি কর্মচারীরা কৃষকদের ওপর নানা ধরনের চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পঙ্গু করে দেয়। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কৃষকদের ওপর নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতনের তথ্যও জানা যায়। যেমন- দণ্ডাঘাত, বেত্রাঘাত, প্রচণ্ড শীতে জলমগ্ন করা, কারাবুদ্ধ করে উপোস রাখা ইত্যাদি।

জমিদার-কৃষক সম্পর্কের অবনতি :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের ফলে এদেশের জমিদাররা কৃষকের সাথে চরম দুর্ব্যবহার শুরু করে এবং এ দুর্ব্যবহারের একমাত্র কারণ ছিল কৃষকদের নিকট থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়। এছাড়াও জমিদারদের  কতৃক নিযুক্ত  মধ্যস্বত্বভোগীরা এদেশের কৃষকদের ওপর নানামুখী নির্যাতন চালাত।

জমিবিইীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি :

তৎকালীন জমিদার ও মধ্যস্বত্বভােগীদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে এদেশের কৃষকসমাজ চরমভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জমিদাররা কৃষকদেরকে  একদিকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতা, অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ে কৃষক ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়।

পেশাজীবী শ্রেণির উদ্ভব :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশে কিছু কিছু পেশাজীবি শ্রেণির উদ্ভব হয়। কৃষক এবং জমিদারদের মধ্যকার সংঘর্ষ ও মামলা-মাকদ্দমার সূত্র ধরে এসব পেশাজীবীদের উদ্ভব হয়। যেমন উকিল, মােক্তার ইত্যাদি।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রমাণও পাওয়া যায়। অধিকাংশ জমিদারের বিরুদ্ধ অত্যাচার ও নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও তাদের কেউ কেউ এদেশের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করেছিলেন। তত্কালীন জমিদাররা এদেশে অসংখ্য খাল খনন, বিদ্যালয় নির্মাণ, চিকিত্সালয় নির্মাণসহ প্রভূৃতি উন্নয়নমূলক কাজ-
করে। যা এদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্রয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
প্রভাব স্পস্টত নেতিবাচক। তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তত্কালীন সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়ন করে।
আইনের মাধ্যমে তৎ্কালীন ব্রিটিশ সরকারের তাৎক্ষণিক লাভ হলেও এ ব্যবস্থার মাধ্যমে এদেশের কষকদেরকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। এদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পিছনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দায়ী বলে অনেকে মনে করেন।

শেয়ার করুন :

Leave a Comment