প্রশ্ন : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কী? ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর। অথবা, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে কী বুঝ? ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােজনীয়তা বর্ণনা কর।
ভূমিকা
রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে “ক্ষমতা। মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হরার পরই ক্ষমতা রাজনীতির এক ব্যাপক আলোেচ্য বিষয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কেন্দ্রীভৃূত ক্ষমতা একদিকে সরকারকে স্বেচ্ছাচারী করে তালে অন্যদিকে নাগরিক স্বাধীনতাও খর্ব করে। তাই সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা ও নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি’ তত্ত্রে উদ্ভাবন করেন। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সর্বপ্রথম ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবর্তন করেন। আধুনিক কালে মন্টেস্কু এ নীতির ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কি
ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ বলতে সরকারের ক্ষমতার বিভক্তিকরণকে বুঝায়। একটি দেশের সরকারের আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়ােগ ও বিচারের ক্ষমতা থাকে। এসব ক্ষমতা একটি কর্তৃপক্ষের হাতে অর্প্ণ করা খুবই ভয়ানক। তাই সরকারের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বলতে এমন এক অবস্থাকে বুঝায় যেখানে সরকারের তিনটি বিভাগ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ নিজেদের গণ্ডির আওতায় থেকে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ না করে নিজেদের ওপর অর্জিত ক্ষমতা স্বতন্ত্রভাবে, স্বাধীনভাবে ভােগ করবে ও দায়িত্ব পালন করবে। এদের সংগঠনের প্রকৃতি, কাঠামাে হবে স্বতন্ত্র। আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করবে, শাসন বিভাগ শাসনকার্য পরিচালনা করবে ও বিচার বিভাগ বিচার কার্য সম্পন্ন করবে। কেউ কারাে কাজের ওপর হস্তক্ষেপ করবে না। ক্ষমতা স্বতন্ত্রকরণ বলতে স্বাভাবিকভাবে যা বুঝায়- ১. সরকারের তিনটি বিভাগ পৃথকভাবে সংগঠিত হবে। ২. প্রত্যেকটি বিভাগ তাদের নিজস্ব সীমারেখার আওতায় সীমাবন্ধ থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবে।৩. কেউ কারোে কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির যতেই সমালােচনা করা হােক না কেন এর রাজনৈতিক মূল্য অপরিসীম। তাই এটি একেবারে অসার কিছু নয়। এর যতই দুর্বল দিক থাকুক না কেন, এর অন্তর্নিহিত সত্তা অস্বীকার করার উপায় নেই। নিচে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা করা হলাে :
১. স্বেচ্ছাচারিতা রােধ :
সরকারের সব ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে থাকলে সে ব্যন্তি স্বেচ্ছাচারী শাসকে পরিণত হতে পারে। কাজেই সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা বিভন্ন ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করলে শাসকগণ স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। সুতরাং ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করে। ম্যাডিমন বলেন যে, “The accumulation of all powers
legislative, executive of one judicial in the same body whether hereditary self appointed or elective many justy be pronounced as the very detention of tyranny.”
২. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা :
ব্যক্তিম্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। আর
মাধ্যমেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। সুতরাং ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা যায়।
৩. সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি :
ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগের ফলে আইন ও শাসন বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কারণ এ নীতি প্রয়ােগের ফলে প্রত্যক বিভাগ একটি কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
৪. বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি :
ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমে সরকারের প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের কাজে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে। সুতরাং বলা যায়, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ব্যক্তিগণ ধীরে ধীরে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন।
৫. ভারসাম্য নীতির প্রবর্তন :
ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হিসেবে ভারসাম্য ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণর নীতির প্রবর্তন মূলত ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিরই ফসল। অর্থাৎ, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ এর ফলেই ক্ষমতা ভারসাম্য নীতির আবির্ভাব ঘটে।
আরও পড়ুন>> যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কী? যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর
৬. ক্ষমতা সুষ্ঠু প্রয়ােগ :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ফলে ক্ষমতা বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। তাই তারা তাদের ক্ষমতাকে বিভিন্নভাবে ভিন্ন ভিন ব্যক্তির ওপর সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করে। এতে ক্ষমতার সুষ্ঠ প্রয়ােগ নিশ্চিত হয়। প্রত্যেক ব্যক্তিই ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে মুক্তি লাভ করে।
৭. নাগরিক চেতনার বিকাশ :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি নাগরিক চেতনা বিকাশের অপরিহার্য শর্ত। স্মষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব না হলেও কিছুটা যে প্রয়াজন একথা কেউ অস্বীকার করবে না।
৮. শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা :
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ফলে সরকারের প্রত্যেকটি বিভাগ তাদের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করে। ফলে তারা তাদের দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবেই পালন করে। এতে তাদের প্রত্যেকটি বিভাগই শাসনকার্যের ক্ষত্রে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
৯. ক্ষমতার মুখ্য ভূমিকা :
অ্যালান বল ক্ষমতাকে রাজনৈতিক প্রভাবের একটি দৃষ্টান্তরূপে উল্লেখ করেছেন। তিনি ক্ষমতাকে একটি মুখ্য ধারণারূপে উল্লেখ করে বলেন যে, রাজনীতিকে যদি বিরােধ মীমাংসার একটি প্রক্রিয়া বূপে গণ্য করা হয়, তাহলে কোনাে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার বষ্টন বিরোধ মীমাংসার প্রক্রিয়া নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করতে বাধ্য। বিরােধের সাথে জড়িত সব পক্ষ মীমাংসার বাস্তবায়নে উৎসাহী কি না ক্ষমতা বন্টনের প্রকৃতির মাধ্যমই তা অনুধাবণ করা সম্ভব হয়।
১০. মূল্য নির্ণয় বা মূল্যের প্রতীক :
ল্যাসওয়েল ও ক্যপলান বলেছেন যে, অনেক সময় ভিত্তি প্রদর্শনী ও হুমকির সাহায্যে আকাঙ্কা পূরণ করা যায় এবং এটি ক্ষমতার বৈশিস্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে ক্ষমতার গুরুত্ব রয়েছে। ল্যাসওয়েল ও ক্যপালন ক্ষমতাকে তাই মূল্য নির্ণয় বা মূল্য প্রতীক হিসেবে অভিহ্ত করেছেন। তারা আরও বলেন, “ক্ষমতা নিজেই একটি মুল্য এবং অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ মুল্য।” এই ক্ষমতা প্রয়ােগ করে আন্দোলনকারীদের আন্দোলন দমন করা যায়, বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি দূর করা যায় এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলাোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যেসব ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে এর মধ্যে নিংসন্দেহে ক্ষমতার ধারণা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ । ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে দীর্ঘকাল ধরে প্রভাবিত করে চলেছে। সামপ্রতিককালের জাতীয় অথবা রাজনীতির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা প্রভৃতি কোানাে ক্ষেত্রেই ক্ষমতার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। তাই বলা যায়, যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির গুরুত্ব অত্যধিক।