প্রশ্ন : সংসদীয় সরকার কাকে বলে? সংসদীয় সরকারের দোষ-গুণ আলােচনা কর অথবা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার কাকে বলে? এ সরকারের দোষগুণ আলােচনা কর অথবা সংসদীয় সরকারের ইতিবাচক দিক ও নেতিবাচক দিক আলোচনা কর।
ভূমিকা
সাম্প্রতিককালে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। আর এই শাসনব্যবস্থাকে আইন পরিষদ ও শাসন বিভাগের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা : মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা। বহুগুণে গুণান্বিত এই শাসনব্যবস্থা সর্বজন স্বীকৃত শাসনব্যবস্খা। কিন্তু সব ধরনের শাসনব্যবস্থারই কিছু না কিছু দোষত্রুটি থাকে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। সংসদীয় সরকারের কিছু নেতিবাচক দিক বিদ্যমান।
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার কাকে বলে
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বলতে এমন এক ধরনের সরকারকে বুঝায়, যে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ তাদের কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner) বলেন, “মন্ত্রিপিরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে প্রকৃত শাসক বা মন্ত্রিপরিষদ তার রাজনৈতিক কার্যাবলির জন্য প্রত্যক্ষ ও আইনসঙ্গতভাবে আইনসভা বা এর একটি কক্ষের নিকট দায়ী থাকে এবং অবশেষে নির্বাচকমণ্ডলীর নিকট দায়ী থাকে। এখানে নামমাত্র শাসক, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির পদটি তেমন পুরুত্বপূর্ণ নয়।”
অধ্যাপক হারম্যান ফাইনার (Herman Finer) বলেন, “মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার হচ্ছে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এমন এক সংস্থা, যার সদস্যবৃন্দ আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা দলসমূহের মধ্য থেকে নিয়াগ লাভ করেন এবং যারা সচরাচর ঐ সংস্থারই সদস্য এবং আইনসভার আস্থা লাভসাপেক্ষে ক্ষমতাসীন থাকেন ও ক্ষমতা কার্যকর করেন। জনগণ সরাসরি সরকারের স্থায়ী কর্মচারী কিংবা আইনসভার সংস্পর্শে আসে না। রাজনৈতিক দলগুলাে আইনসভাকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও অনেকটা পরােক্ষভাব পরিচালিত করে।”
অধ্যাপক ডাইসি (Dicey) বলেন, “মন্ত্রিসভা শাসিত সরকার শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগীয় ক্ষমতা একত্রীকরণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে।” সুতরাং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বলতে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা বুঝায় যেখানে শাসনক্ষমতা মন্ত্রিপরিষদের হাতে ন্যস্ত থাকে। মন্ত্রিসভা প্রায় কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়বদ্ধ থাকে। রাষ্ট্রপ্রধান থাকে দুইজন। একজন প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী তার আরেকজন নামমাত্র প্রধান মন্ত্রিপরিষদের সকল মন্ত্রীকে আইন পরিষদের মধ্য হতে মনােনয়ন করা হয় বলে এ শাসনব্যবস্থাকে পার্লামেন্টারি সরকার বলা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের ইতিবাচক দিক
সংসদীয় সরকারের দোষ-গুণ আলােচনা আলোচনা প্রথমে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের ইতিবাচক দিক নিম্নে উল্লেখ করা হলাে :
১. আইন ও শাসন বিভাগের সুসম্পর্ক :
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতি এই ব্যবস্থায় কার্যকর করা হয়
না। আইনসভা ও শাসনবিভাগ যৌথভাবে জনকল্যাণমূলক কাজে অগ্রগতি সাধন করে।
২. গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় থাকে :
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা হলাে প্রকৃত শাসক। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ আবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসেন। দলে জনগণের প্রতিনিধিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করেন। আবার আইনসভার গঠনও হয় এরকম জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা। এভাবে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় থাকে।
৩. দায়িত্বশীল ব্যবস্থা :
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার তার কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়বদ্ধ থাকে। ফলে সরকারের যেকোনাে কাজের জবাবদিহিতা করতে হয়। এইভাবে সংসীয় সরকার ব্যবস্থা একটি দায়িত্বশীল ব্যবস্থার রূপ নেয়।
৪. স্থায়ী সরকার ব্যাবস্থা :
সরকারের স্থায়ী মন্ত্রিসভা শাসিত সরকারের অন্যতম গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যরাই মন্ত্রিসভা গঠন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব মােটামুটি নিশ্চয়তার মধ্যে থাকে।
৫. নমনীয় শাসনব্যবস্থা :
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা যদি জনগণের আস্থা হারানাের মতাে কোনাে সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে অনাস্থা জ্ঞাপনের মাধ্যমে তার পরিবর্তন ঘটানাে সম্ভব। এইভাবে সংসদীয় ব্যবস্থা নমনীয় ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. সচেতনতা সৃষ্টি :
সরকারি কর্মকাণ্ডে জনগণের মতামত প্রয়ােজনীয় সুযােগ থাকায় মানুয রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলি এবং রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করতে পারে।
৭. বিরােধী দলের মর্যাদা :
জনমতকে সরকারের কাছে পৌছিয়ে দেয় বিরােধী দল। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরােধী দলকে মর্যাদাবান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরও পড়ুন >> গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের পার্থক্য আলোচনা কর
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের নেতিবাচক দিকসমূহ :
সংসদীয় সরকারের দোষ-গুণ আলােচনা করতে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের নেতিবাচক দিকসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলা :
১. সুশাসনের অন্তরায় :
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতি কার্যকর হয় না। ফলে শাসন বিভাগ আইনসভার দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত হত যথাযথভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে আসুবিধা হয়। ফলে শাসনকার্য ব্যাহত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
২. জরুরি অবস্থায় অনুপযাোগী :
সরকারের দ্রুত সিন্ধান্ত গ্রহণের সময় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাধা প্রদান করে। সবার মতামতের জন্য জরুরি অবস্থায় সিন্ধান্ত গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।
৩. দলব্যবস্থায় সমস্যা :
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় একাধিক দলীয় ব্যবস্থা কার্যকর থাকায় নানারিকম ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। সংকীর্ণ দলীয় আচরণ, দলাদলি, যােগ্যতার উপেক্ষা, দলীয় স্বার্থসাধন প্রভৃতি কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
৪. দুর্বল ও আস্থায়ী :
সরকারের স্থায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আইনসভার হাতে ন্যস্ত থাকে। আইনসভা অনাস্থা জ্ঞাপন করলে সরকার ভেঙে যেতে বাধ্য থাকে। ফলে সরকার অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অস্থায়ী প্রকৃতির হয়।
৫. নব্য স্বৈরাচার :
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকারি দল যদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে তবে, তারা নিজেদের মতাে করে শাসনকাজ পরিচালনা করতে পারে। ফলে স্বৈরাচারী মনোভাব জাগ্রত হয়।
৬. অযােগ্যদের শাসন :
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন কেউ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী সুযােগ নিয়ে ধূর্ত, চালাক, অযােগ্য ও অশিক্ষিত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয় সরকার গঠনে অংশগ্রহণ সুযােগ লাভ করে।
৭. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি :
সংসদীয় পদ্ধতিতে মন্ত্রিসভার সদ্যগণ আইনসভার সদস্যদের ওপর নিভরশীল থাকায় মন্ত্রীগণ আইনসভার সদস্যদের দুর্নীতির মাধ্যমে স্বীয়স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে থাকে।
৮. ধনতন্ত্র প্রভাব :
অনেকের মতে সংসদীয় সরকারের সঙ্গে ধনতন্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে। এই সরকার ব্যবস্থায় ধনীরা সরকারি কাজে প্রভাব বিস্তার করে সুবিধা নেওয়ার সুযাগ পায়। ফলে সাধারণ জনগণ বাঞ্চনার শিকার হয়।
উপসংহার
উপরোক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আইনসভা ও শাসন বিভাগের সুসম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা। বর্তমান বিশ্বে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারই সর্বোৎকৃষ্ট সরকার। এই সরকার অন্যান্য সরকার ব্যাবস্থার চেয়ে গণতান্ত্রিক, দ্বায়িত্বশীল ও সময়ােপযােগী। তাই এই সরকারের কিছু নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও তা সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা।